স্টাফ রিপোর্টার::
সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলায় বিরোধের জেরে বর্ষার পানি নিষ্কাশনের একমাত্র পথ ইটপাথর দিয়ে স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেয় গ্রামের আমির হোসেন নামের প্রভাবশালী এক যুবক। যথা ফলে গত দুই বছর ধরে তাহিরপুর উপজেলার উত্তর বাদাঘাট ইউনিয়নের ঘাগড়া গ্রামের ৫০টি পরিবারের প্রায় ৩শতাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে । পানি নিষ্কাশনের রাস্তা বন্ধ থাকায় জমে থাকা পানি শতবছরের পুরনো বাদাঘাট টু ঘাগড়া সড়কের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে তিন স্থানে ভেঙে গিয়ে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ হওয়ার উপক্রম দেখা দিয়ে। গ্রামের পানি নিষ্কাশনের রাস্তায় দেয়া বাধঁ দ্রুত অপসারণ না করে দিলে এবং আরও কয়েক দিন এরকম টানা বৃষ্টিপাত হলে ওই সড়ক ভেঙে গিয়ে এর আশপাশে থাকা প্রায় ৫০ টি গ্রামের মানুষের এই সড়ক দিয়ে যাতায়াতে দূর্ভাগা পোহাতে হবে। সেই সাথে জমে থাকা পানির কারণে এখানকার প্রায় ১০০ কেয়ার জমিতে( ৩০ শতাংশে এক কেয়ার) কোন ফসল না করতে পারায় গত দুই বছর ধরে অনাবাদি রয়েছে।
গতকাল ১ জুলাই সোমবার তাহিরপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আফতাব উদ্দিনের কাছে গ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে ভুক্তভোগী প্রায় ৫০টি পরিবারের গণস্বাক্ষরীত একটি আবেদন করেন।
গতকাল ২ জুলাই মঙ্গলবার সকাল দশটায় সরেজমিনে ঘাগড়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, বর্ষায় ঘাগড়া গ্রামের বৃষ্টির পানি যুগযুগ ধরে যে নালা দিয়ে হাওরে গিয়ে পড়তো। সেই পানি নিষ্কাশনের নালা (রাস্তায়) ওই গ্রামের মৃত আব্দুল হামিদের ছেলে আমির হোসেন (৩০) নিজের প্রভাব কাটিয়ে ইটপাথর দিয়ে স্থায়ীভাবে বাধঁ দিয়ে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা বন্ধ করে দেয়।
জানাযায়, গ্রামের লোকজনদের সাথে বিভিন্ন বিষয়াদি নিয়ে বিরোধের জের ধরে ওই বাধঁ দেয় আমির হোসেন। যার ফলে দেখা গেছে, আটকে থাকা পানি ওই এলাকার একমাত্র বাণিজ্যিক কেন্দ্র বাদাঘাট-ঘাগড়া সড়ক পানিতে ডুবে আছে। ওই সড়কের উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়ে সড়কের তিন স্থানে ভেঙে গিয়ে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম দেয়া দিয়েছে। পানি নিষ্কাশনের রাস্তা বন্ধ করে দেয়ায় জমে থাকা পানিতে গ্রামের খড়ের পালা, বাড়ি-ঘরের আঙিনা এবং সীমানা প্রাচীরের নীচ পর্যন্ত ছুঁই ছুঁই করছে বর্ষার পানি। অনেক বাড়িঘরের ভিতরে পানি উঠে যাওয়ায় তাদের ছোট ছোট শিশু ও পারিবার পরিজন নিয়ে পড়েছেন চরম বেকায়দা। ঘরের সামনে হাঁটু পানি থাকায় বর্ষার কালে মাসের পর মাস বাধ্য হয়েই তাদের ঘরের ভিতর খাটের উপর দিনরাত পাড় করতে হচ্ছে। নর্দমার পানির সাথে বর্ষার পানি মিশে নোংড়া হয়ে পড়েছে। কাজের চাপে সেই নোংড়া পানি ভেঙ্গে গ্রামের মানুষ যাতায়াত করলেও নারী এবং শিশুরা চলাচল করতে পারছে না। বাড়ির আঙিনায় পানি ওঠায় অনেকেই রান্নাও করতে পারছেন না।
পানিবন্দি ভুক্তভোগী ঘাগড়া গ্রামের আজিমুন নেছা (৫৫) বলেন, বাপ-দাদার আমল থাইক্কা দেইক্কা আইছি মেঘের সময় (বর্ষা মৌসুমে)পানি এই জায়গা দিয়া আওর( হাওরে) পানি নামছে। অখনে ২/৩ বছর ধইরা আমির হোসেন নামের একবেডা কিনন্না পানি যাওয়ার রাস্তাত ইট দিয়া বান( বাধঁ) দিয়া দিছে। আমির হোসেন টাকাপয়সায় প্রভাবশালী ব্যক্তি তাই পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ করে দেয়। এইতাইক্কাই আমরা পরিবার লইয়া রাইতে দিনে ইলাখান পানির মাইঝে পইরা তাকি। কত কষ্টভোগ করি। আমরা গরীব মানুষ কাম-কাজ কইরা খাই। এই পানির লাগি ছুডুছুডু(ছোট ছোট) পুলাপাইন তইয়া খাম কাজও করতা যাইতারিনা। ঘরের সামনে আডু(হাটু) পানি। এইলাখান যদি পানি থাকে আমরা কামও যাইতা পারতামনা, অন্নে পুলাপান লইয়া না খাইয়া ঘরের ভিতরেই মরণ লাগব।
ভুক্তভোগী আব্দুল করিম(৭১) বলেন, আমির হোসেন প্রভাবশালী মানুষ। তার টাকাপয়সা অনেক। সড়কের সাথে সরকারি জায়গা দখলে নিয়ে গ্রামের পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ করে দেন। প্রতিবাদ করনে আমির হোসেন গতবছর আমাদের নামে মিথ্যা মামলা করে। গতবছর বাদাঘাট ইউনিয়নের আফতাব উদ্দিন ও নিজাম উদ্দিন দুই চেয়ারম্যান ও স্থানীয় দুই মেম্বার সরেজমিন এসে বাধঁ ভেঙে দিয়ে পানি নিষ্কাশনের জন্য বলে গেলেও আমির হোসেন তা করেনি। উল্টো ইটপাথর দিয়ে আরও শক্তকরে বাধঁ দেয়।
ওই গ্রামের আমরা গ্রামের শাফিয়া বেগম(৬০) বলেন, এইখান ড্রেইন আছিন, আজীবন এই ড্রেইন দিয়া পানি নামছে। অন্নে পাক্কাচাক্কা কইরা বান দেলাইছে। অন্নে মেঘ আইলেই পানি লাইজ্ঞা থাকে, রানধা খাওয়া নাই। পুরুতা (শিশুরা) বাইরইত পারেন। স্কুল যাইতারে না, ঘরের সামনে উডান আডু পানি। কুন সময় পুরুতা পানিত পইরা মইরা থাকে এর লাইজ্ঞা আমরা দিনেও ঘুমাইতা পারিনা, রাইতও ঘুমাইতা পারিনা। আমরা আগদা উগদা পারিনা, পুরুতার আগামুতা ঘরের দাইরই বওয়াইয়া করাই, আমরাও করি। এইতা পানিত আডাছড়া কইরা পুরুতার পাতলা পায়খানা অইতাছে, কাজলি মাজলি অইতাছে। আমরা পানির ডরে( ভয়ে) পুলাপান রাইখা কাম যাইতাম পাইনা। কাম করতাল্লে টেকা পাইমু, টেকে না থাকলে কেমনে পুরতার লাগি আষুদ( ঔষধ) আনমু। আমরা ইনু ( ইউএনও) স্যার, চেয়ারম্যান মেম্বাররারে অনুরোধ করতাছি এই বান ছুটাইয়া দিয়া পানি নামার ব্যবস্থা কইরা দেয় আল্লারস্তে। নাইলে যেকোনো সময় আমরার বাচ্চাকাচ্চারা পানিত পইরা মইরা থাকব। কাইতাম পারতাম না।
ঘাগড়া গ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা নুর হোসেন মল্লিক(৬০) বলেন, যেখান বাধঁ দিয়েছে এদিক দিয়ে একটা খাল ছিল। কিন্তু গত দুই বছর পূর্বে উত্তর হাটির(পাড়ার) আমির হোসেন এই জায়গা কিনে এই খাল মাটি ভরাট করে গ্রামের পানি নিষ্কাশনের খাল বন্ধ করে দেয়। শুধু বন্ধই করেনি। সে ইটপাথর দিয়ে পানি নার রাস্তায় স্থায়ীভাবে বাধঁ দেয়ার কারণে গত দুই বছর ধরে এখানে বসবাসকারী ৫০ পরিবারের প্রায় ৩ শত মানুষ পানির নিচে হাবুডুবু খায়। এবং এই বাধেঁর উত্তরে গ্রামের প্রায় ১০০ কেয়ার জমি বর্ষায় পানির নিচে থাকে। আমাদের একমাত্র সম্বল আমন ফসল। এটাও দুই বছর ধরে করতে না পায় জমি গুলো পতিত রয়েছে। এখানে বসবাসরত সবাই গরীব। অধিকাংশ মানুষ শ্রমজীবী ও কৃষক। তার নদীতে কাজ করলে পেটে ভাত জুটে নাইলে উপাস থাকে। তিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা চেয়ারম্যান সহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি অতিদ্রুত গ্রামের জমে থাকা পানি নিষ্কাশনের একটি ব্যবস্থা করে দিয়ে তাদেরকে এই দুর্ভোগের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য।
একই কথা এই গ্রামের ভুক্তভোগী কালা মিয়া(৬৫), জালাল উদ্দিন (৭১), আব্দুল আহাদ(৫৫) জানন, শুধু আমরা পানিবন্ধী না এখন পানি উপরে আমাদের যাতায়াতের একমাত্র সরকারি সড়ক ভাঙতাছে। রাস্তা ভাঙ্গায় গ্রামবাসী অটো বা ভ্যান নিয়ে গ্রামে ঢুকতেও পারছেন না। আমরা খুব কষ্টে আছি। গত দুইবছর ধরে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানকে বলেও কোন সমাধান হয়নি। নির্বাচনের আগে প্রার্থীরা সমাধানের ব্যবস্থা করার আশ্বাস দিয়ে শুধু ভোট নিয়েছেন। এখন তারা পাত্তাই দিচ্ছেন না। তার আরও বলেন, পানিবন্দি হওয়ায় গ্রামের ছেলে-মেয়েরা স্কুলে যেতে পারছে না।
গ্রামবাসীর অভিযোগের ভিত্তিতে এ বিষয়ে কথা বলতে গেলে অভিযুক্ত ঘাগড়া গ্রামের আমির হোসেন (৩০) দৈনিক শুভ প্রতিদিন'কে বলেন, আমি এই জাগা কিনছি। কিনে মাটি পালাইয়া বাড়ি বানছি। এখন এই জাগা দিয়া পানি যাইবার লাগি দিলে আমার মাটি সব কাইটা যায় গা। এই কারণে আমি ইট দিয়া বান দিছি। তিনি শুভ প্রতিদিন'কে আরও বলেন, গ্রামের দানা মুরুব্বি ও স্থানীয় দুই চেয়ারম্যান ও মেম্বার কয়েকবার বিষয়টি সমাধানের জন্য বসা হইছে। তার পরেও সমাধান হচ্ছেনা। তবে কেন সমাধান হচ্ছেনা এ বিষয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, এইখানের জমে থাকা পানি ফাইভ দিয়ে যাওয়ার জন্য ২০/২৫ হাজার টাকা লাগব, আমি কইছি ৫/৭ হাজার টাকা আমি দিমুনে বাকি টাকা তারা (গ্রামবাসী) দিতা পারতাছে না। এখন আমি কিতা করমু। আমি বান( বাধঁ) না দিলে আমার বাড়িঘরের মাডি( মাটি) সব যাইবগা। সাবেক বাদাঘাট ইউনিয়ন চেয়ারম্যান বর্তমান উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আফতাব উদ্দিন গতবছর সরেজমিনে এসে পানি নিষ্কাশনের জন্য বাধঁ ভেঙে দেয়ার পরেও আবার কেন বাধঁ দিলেন, উত্তরে তিনি( আমির হোসেন) বলেন, গ্রামের সব পানি আমার এখান দিয়ে গিয়ে আমার বাড়ির সব মাটি পানির সাথে যায়গা। তাই ইট দিয়া বান দিছি।
এ বিষয়ে জানতে তাহিরপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আফতাব উদ্দিনের মুঠো ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, গ্রামবাসী পানি নিষ্কাশনের জন্য আমার কাছে একটি আবেদন নিয়ে আসছিল। আমি এর আগেও বাধঁ ভেঙে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করে দিয়ে আসছিলাম। এখন যদি আবার ওই স্থানে বাধঁ দিয়ে থাকে তাহলে আমি সরেজমিনে দেখে অতিদ্রুতইওই গ্রামের জমে থাকা পানি নিষ্কাশনের জন্য বাধঁ অপসারণ করে দিয়ে আসবো।