উজ্জ্বল কুমার সরকারঃ
আজ ০৫ জুলাই ভারতীয় চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় অভিনেতা শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় (২৯ নভেম্বর ১৯৩৬ - ৫ জুলাই ২০০৭) এর প্রয়াণ দিবস। তিনি ১৯৩৬ সালের ২৯ নভেম্বর কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তিন ছিলেন একজন ভারতীয় চলচ্চিত্র এবং টেলিভিশন অভিনেতা, যিনি মূলত বাংলা ভাষায় অভিনয় করতেন।
ভারতীয় চলচ্চিত্রের অন্যতম অভিনেতা। বাবা-মায়ের ইচ্ছে ছিল সন্তান ডাক্তার হবে। সেভাবে পড়াশোনাও চালিয়ে গেছেন। ডাক্তারি পাশ করে যদি চিকিৎসক না হওয়া যায় তাহলে আর পড়াশোনা করে কী লাভ! ডাক্তারি নিয়ে পড়াশোনা করলেও রূপোলি পর্দার প্রতি শুভেন্দু চট্টোপাধ্যা এর টান ছোটো থেকেই। ছোট্টবেলায় শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় কিচ্ছুই হতে চাইতেন না। শুধু সবসময় খেলতে চাইতেন। তার সাথে ছিল রকমারী দুষ্টমি। আট-নয় ক্লাস থেকেই প্রেম হয়ে যায় শিল্প-সাহিত্যের সাথে। শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের সেই শুরুয়াৎ। তারপর বহু পাকদন্ডি-সরণী ধরে চলচ্চিত্রের রাজপথে। সিনেমাজগতের ব্যতিক্রমী অভিনেতা ছিলেন শুভেন্দু চাট্টোপাধ্যায়। শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৩৭ সালের ২৯ শে নভেম্বর¯। বাবা শৈলেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মা মণিমালা দেবী। স্কুল জীবন কেটেছে হাওড়ার বালিতে। শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের প্রথমে পাড়ায় নাটকে অভিনয়, গান-বাজনা, ডিবেট আরো কত কী করেছেন। সেসময়ে তাঁর গল্প-কবিতা ছাপা হয়েছে কিছু অনামী পত্র-পত্রিকায়। পেশাদার নাটক দেখার প্রথম অভিজ্ঞতা ১৯৩৭ সালে।
নাট্যাচার্য শিশির কুমার ভাদুড়ির ‘মাইকেল মধূসূদন’ পালা দেখার পর পরই তার ভেতরের চিন্তা ভাবনা নুতন করে কিছু একটা খুজে পেলো। এই নাটকই উল্টেপাল্টে দিল তাঁর জীবনের গ্রামার।
শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের মাথায় চিরতরে ঢুকে গেল অভিনয়ের পোকা। অভিনয় দেখাটা যদি এমন আনন্দের হয়; তবে অভিনয় করাটা কতই না মজাদার হবে!
১৯৫৩ সালে স্কুল ফাইনাল কৃতিত্বের সাথে পাস করেন। ঠাকুর্দা ছিলেন ইংরেজ জামানার সিভিল সার্জেন। হ্যাট-কোট পরা বেশ সম্মানীয় ব্যাপার। বাবার ইচ্ছে ছিল যে তার কোন এক ছেলে ডাক্তার হোক।
ভর্তি হলেন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে। ১৯৫০ সালে এম.বি.বি.এস পাস করলেন মেধা তালিকায় । ১৯৫৮-৫৯ সালেই তিনি ঠিক করে ফেলেছিলেন পুরোদমে অভিনয় করবেন। ডাক্তারী পাশের পর আই.পি.টি.এ-তে যোগ দেন। রবীন্দ্র জন্ম শতবার্ষিকী উৎসবে ‘নৌকাডুবি’-তে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেন।এ সূত্রেই পরিচয় হয়ে গেল মৃণালবাবুর সাথে।
মৃনাল সেন একদিন বললেন-‘‘একটা ছবি করছি ‘আকাশ কুসুম’ । নায়কের বন্ধুর একটা রোল আছে, তোমাকে মানিয়ে যাবে’’। সিনেমা প্রেমীদের আজও মনে পড়ে আকাশ কুসুমের সেই বন্ধুটির কথা।
নায়ক সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যার কাছ থেকে জামা-প্যান্ট ধার করে নিয়ে যেত; নায়িকাকে ইমপ্রেস করতে। ‘আকাশ কুসুম’ মুক্তির পর শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়কে আর বাড়তি পরিচয় দেবার দরকার হয় নি।
তখন তিনি চাকরী করছেন। প্রথমে সিভিল ডিফেন্স ও পরে কলকাতা পুরসভার মেডিকেল অফিসার পদে। দেখলেন মেডিকেল অফিসারী আর অভিনয় একসাথে করা যাবে না। চাকরীটা ছেড়ে দিলেন। বাবাকে বললেন- ‘‘তোমার ইচ্ছা ছিল ছেলে ডাক্তার হোক; হয়েছে, এবার জীবনটা আমার, সেটা আমার মতো করে কাটাবো। অতএব আমাকে আমার মতো চলতে দাও’’। তারপর একের পর এক ছবিতে অফার আসতে লাগলো শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের নিকট । নায়কের রোল পেলেন ‘শীলা’ ছবিতে। তারপর ‘হংস মিথুন’। পাশাপাশি চলছে মঞ্চ অভিনয়। শ্যামবাজারী পেশাদারী নাটকে নিয়মিত অভিনেতা। তাঁর নির্দেশনা ও অভিনয়ে ‘অমর কণ্টক’ এক জনপ্রিয় পালা। তেমনভাবে শিশির ভাদুড়ির ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ তাঁর হয়নি। দু’ একবার প্রণাম টণাম করার সূযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু একলব্যের মতো তাকেই দ্রোণাচার্যের স্থান দিয়েছিলেন। শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের ড্রয়িং রুমে রাখা নাট্যাচার্যের ছবিটি সেই কথাই মনে করিয়ে দেয়। সত্যজিৎ রায়ের সাথে তাঁর প্রথম আলাপ তেমন কাজের হয়নি। সত্যজিৎবাবু তাঁর নতুন ছবির জন্য শিল্পী খুঁজছিলেন। রবি ঘোষ সে কথা শুভেন্দুদাকে বলেন।
শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় একদিন গেলেন সত্যজিৎবাবুর কাছে। কিন্তু কিছুকথা হওয়ার পর সত্যজিৎ রায় মুখের ওপর জানিয়ে দিলেন-‘‘যে রোলের জন্য শিল্পী খুঁজছি সেখানে তোমাকে ঠিক মানাবে না’’।
শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় সে সময়ের জন্য হতাশ হয়েছিলেন। আবার ‘চিড়িয়াখানা’র সময় নিজে থেকেই শুভেন্দুবাবুকে ডেকে পাঠান সত্যজিৎ রায়। তারপর ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ থেকে ‘গণশত্রু’ তো সবটাই ইতিহাস।
প্রায় চল্লিশটি ছবিতে তিনি নায়কের ভূমিকায় সদর্পে অভিনয় করেছেন। তারপর চরিত্রাভিনেতা-সেটাও দীর্ঘ পথের যাত্রা। স্বকন্ঠে গান করেছেন সুখেন দাসের চলচ্চিত্রে।
শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের ফ্লিমি ইমেজটা কারো কারো প্রচারে কাজে লাগানোর উদ্দেশ্য নিয়ে তাঁর কাছে গিয়েছেন। একে তো কোন আদ্দিকালে পাশ করেছেন; তার ওপর সেভাবে ডাক্তারী করেন না।
এইসব কার্ডিওলজির ডাক্তারী ব্যাপার স্যাপার কী আর বুঝবেন। একজন পান্ডুলিপি লিখে তাঁর হাতে ধরিয়ে দেওয়ার পর তার সে ভাবনা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এক চিকিৎসকের লেখা হৃদরোগ সংক্রান্ত ‘হৃদয়ের কথা’ বই তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েছেন। বহু জায়গায় বিষয়গত ভুল ধরিয়ে দিয়েছেন। ‘ফ্যালটস টেট্রালজি’ হৃদবিজ্ঞান বা কার্ডিওলজির এক জটিল বিষয়। এ সম্বন্ধে যে সংজ্ঞা তিনি লিখেছিলেন তা কিছুটা অস্পষ্ট ছিল। শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় তা সুন্দরভাবে সম্পাদনা করেন। পেশাগত ভাবে চিকিৎসক না হওয়া সত্তে¡ও চিকিৎসাবিজ্ঞান সম্বন্ধে তাঁর জ্ঞান ছিল আপ টু ডেট।
গম্ভীর ও মিশুকে এক অঅদ্ভুত মেলবন্ধন ছিল শুভেন্দুদার মধ্যে। ঘটি বলেই বোধ হয় মিষ্টি খেতে বেশি ভালোবাসতেন; খাওয়াতেনও। বাড়িতে সবসময় সেন মহাশয়ের সন্দেশ থাকতো। প্রিয় চিংড়িমাছ, তবে শেষের দশ বছর তিনি নিরামিষই বেশি খেতেন।
গণনাট্য সংঘে যাওয়ার আগে থেকেই তাঁর একটি সমাজতান্ত্রিক, যুক্তিবাদী মন তৈরি হয়ে যায়। ধর্মের বিষয়ে তাঁর মতামত ছিল খুব পরিষ্কার। মানবতাবাদ ছাড়া আর কোন ধর্মেই বিশ্বাস ছিল না।
শুভেন্দু বেশ মজা করে কয়েকটি কথা বলতেন‘‘হিন্দু, মুসলমান, পার্সি, খ্রীষ্টান ইত্যাদি যত আছে, সবাইতো ভগবানভিত্তিক। কোন ধর্মেই আমি বিশ্বাস করি না; তার কারণ ভগবানেই আমার বিশ্বাস নেই। তাঁর একই ধরনের বক্তব্য ছিল ‘ভাগ্য’ সম্বন্ধে-‘ ‘প্রত্যেকটি কাজ একটা চেন অফ রিয়্যাকশন’’। এই দেখো কুম্বলে বল করছে, বলটা বেঁকল, তলায় শ্যুট করল, গিয়ে উইকেটে লাগল। ব্যাটসম্যান বোল্ড হল। এটা ব্যাটসম্যানের দুর্ভাগ্য না অনিল কুম্বলের সৌভাগ্য? দুটোই কর্ম। বল ছোঁড়াটা একটা কর্ম, ব্যাটসম্যানের প্রতিরোধ করাটা আরেকটা কর্ম। ও সেটা পারল না, ক্রেডিটটা চলে গেল বোলারের কাছে। চিকিৎসক হওয়ার পর অভিনয়ে এসে তিনি নাট্যশাস্ত্রকে ঋদ্ব করেছেন। কথা প্রসঙ্গে একদিন বলেছিলেন-‘‘অ্যানটমিটা জানি বলেই একজন মানুষ রেগে গলে তার মুখের ম্যাসেটার ও টেপোর্যালিসি পেশি কোথায় কেমন হবে তা সহজেই বুঝতে পারি।
কাউকে চেপে ধরতে গেলে হাতের ট্রাইসেস ব্রাকিয়াই ও ব্রাকিও ব্যাডিয়ালিস পেশীতে কতটা চাপ পড়বে তা জানি’’। সত্যজিৎ রায়ও কয়েক জায়গায় ডাঃ শুভেন্দু চ্যাটার্জির এই জ্ঞানের সাহায্য নিয়েছিলেন। পেশাগত ভাবে বেশিদিন ডাক্তারী করেননি। তবে কারা কারা তাঁর দেওয়া ওষুধ খেয়েছেন সেই তালিকাটা যে কোন ডাক্তারের কাছে ঈর্ষার বিষয়। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছবি বিশাস, সমরেশ বসু, পাহাড়ি স্যান্নাল, উত্তম কুমার, সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, সাবিত্রী চ্যাটার্জি, দীলিপ রায় আরো বহু স্বনামধন্য মানুষ। ১৯৬৫ সালে মৃণাল সেনের ‘আকাশ কুসুম’ ছবিতে প্রথমবারের জন্য অভিনয় করেন। সেখানে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও অপর্ণা সেনের পাশাপাশি নজর কাড়েন শুভেন্দু। ১৯৬৭ সালেই সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে কাজ। ‘চিড়িয়াখানা’ ছবিতে সেই প্রথমবার উত্তমকুমার এবং সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ এল। ১৯৬৮ সালে ‘চৌরঙ্গী’র সেই বিখ্যাত চরিত্র শংকর। আবার স্যাটা বোস উত্তমকুমারের সঙ্গে দুর্ধর্ষ কাজ।
তারপর এক এক করে ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, ‘ছদ্মবেশি’, ‘কোরাস’, ‘গণশত্রু’, ‘লাল দরজা’, ‘দহন’, ‘আবার অরণ্যে’-এর মতো কালজয়ী ছবিতে অভিনয় করেন শুভেন্দু। ২০০৩ সাল অবধি চুটিয়ে কাজ করে গেছেন।
কিন্তু ঠিকঠাক মূল্য পেয়েছেন কি! কালের স্রোতে ধীরে ধীরে হারিয়ে গেছে তাঁর নাম। আজ শুধুমাত্র বাংলা চলচ্চিত্রের দর্শক ক’জনই বা মনে রেখেছেন শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের নাম! তিনি ২০০৭ সালের ০৫ জুলাই ভারতের কলকাতায় ৭০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
ইন্ডাস্ট্রিতে তিনি ‘দ্য গ্রেট ডক্টর’। লাইট ক্যামেরা অ্যাকশন কিংবা গলায় স্টেথোস্কোপ – শুভেন্দু থাকবেন শুভেন্দুতেই।
আজ ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম অভিনেতা শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের প্রয়াণ দিবসে জানাই গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।