উজ্জ্বল কুমার সরকার
" সব ক'টা জানালা খুলে দাও না"-
“একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার, সারা বিশ্বের বিস্ময় তুমি আমার অহংকার।” -নজরুল ইসলাম বাবু। নজরুল ইসলাম বাবু এদেশের এক কিংবদন্তি গীতিকারের নাম। আমাদের সংস্কৃতি আর সুরের ভুবনে যিনি স্মৃতির চাদর ছড়িয়ে গেছেন। কালের বিবর্তনে বর্তমান প্রজন্ম এবং অনেক মানুষই ভুলে গেছেন এই প্রিয় মানুষটির কথা।
অথচ ওনার লেখা গান আজও এদেশের সঙ্গীতের ঐতিহ্য বহন করে চলেছে। আমাদের বিখ্যাত দেশাত্মবোধক গান ‘সব ক'টা জানালা খোলে দাওনা’ গানটি সুর করেছেন শ্রদ্ধেয় আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল এবং গানটি গেয়েছেন বাংলা সঙ্গীতের কিংবদন্তি শিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন। এই অমর গানটি নজরুল ইসলাম বাবুর লেখা। দেশাত্মবোধক গান ‘আমায় গেঁথে দাওনা মাগো একটি পলাশ ফুলের মালা’ গানটির সুরকার দেশের মেলোডি কিং শ্রদ্ধেয় আলাউদ্দিন আলী, কন্ঠ দিয়েছেন রুনা লায়লা; ‘একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার’ গানটির সুরকার অজিত রায়, কন্ঠ দিয়েছেন সাবিনা ইয়াসমিন। এছাড়াও চলচ্চিত্রের কালজয়ী গান ‘কত যে তোমাকে বেসেছি ভালো সে কথা তুমি যদি জানতে’ দেশের সুস্থ এবং শুদ্ধ গানের প্রতিভাময় গায়ক সুবীর নন্দীর গাওয়া গানটির সুর করেছেন শ্রদ্ধেয় সুরকার আলী হোসেন, এবং সুবীর নন্দীর মহানায়ক খ্যাত বিখ্যাত গান ‘পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু নেই’ গানটির সুরকার শ্রদ্ধেয় শেখ সাদী খান, এমন অনেক কালজয়ী বিখ্যাত গানের স্রষ্টা ‘নজরুল ইসলাম বাবু’। নজরুল ইসলাম বাবুর লেখা গান গেয়ে অনেক শিল্পীই হয়েছেন নন্দিত, জনপ্রিয়, বিখ্যাত। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে অনেকেই ভুলে গেছেন অকালপ্রয়াত এই হৃদয়বান মানুষটিকে। জন্ম ১৯৪৯ সালের ১৭ জুলাই বৃহত্তর ময়মনসিংহের জামালপুরের মাদারগঞ্জ উপজেলার চরনগর গ্রামের মাতুলালয়ে। তাঁর পৈত্রিক ভিটা একই উপজেলার হেমাড়াবাড়ি গ্রামে। পিতা বজলুল কাদের, মাতা রেজিয়া বেগম। পিতা বজলুল কাদেরের সঙ্গীতানুরাগ ছোটবেলা থেকেই বড় সন্তান নজরুল ইসলাম বাবুকে প্রভাবিত করে। ১৯৭১ সালে তিনি দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। দেশ স্বাধীন হলে তিনি আবার লেখাপড়া, সাহিত্য ও সংগীত চর্চা শুরু করেন।
১৯৭৩ সালে আশেক মাহমুদ কলেজ থেকে বিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। ওই একই বছরে তিনি বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনে গীতিকার হিসেবে তাকিাভুক্ত হন। এরপর একে একে লিখতে থাকেন দারুন সব গান, যার মধ্যে ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না’ এবং ‘একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার’ অন্যতম। সবকটা জানালা খুলে দাওনা’ গানটি তৎকালিন সময়ে বাংলাদেশ টেলিভিশনের খবর এবং বিভিন্ন সৃজনশীল অনুষ্ঠানের সূচনা সঙ্গীতে ব্যবহৃত হত। পরবর্তীতে এই গানটি চিত্র পরিচালক কাজী হায়াত ১৯৯২ সালে ‘সিপাহী’ ছবির টাইটেলেও ব্যবহার করেছিলেন। এই গানটি ছাড়াও নজরুল ইসলাম বাবু’র লিখা দেশাত্মবোধক গানগুলোও আজও বিভিন্ন জাতীয় দিবসে গাওয়া হয়। কণ্ঠশিল্পী দিলরুবা খানের কণ্ঠের ঝড় তোলা ‘দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা’ গানটিও নজরুল ইসলাম বাবুর লিখা। তিনি বাংলাদেশ গীতিকবি সংসদের প্রথম কার্যনির্বাহী পরিষদ (১৯৭৮-৭৯) এর সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭৮ সালে সুরকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সাথে তিনি প্রথম চলচ্চিত্রে গান লিখতে শুরু করেন।
চলচ্চিত্রে নজরুল ইসলাম বাবুকে আমরা পেয়েছি ‘দুই পয়সার আলতা’, ‘মহানায়ক’, ‘প্রতিরোধ’, ‘উসিলা’, ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘প্রেমের প্রতিদান’ এর মতো দারুন সব চলচ্চিত্রের দারুন দারুন সব গানে। শুধু বাংলাদেশের সাবিনা ইয়াসমিন , রুনা লায়লা ,সুবীর নন্দী, এন্ড্রু কিশোরের মতো শিল্পীরাই নয় নজরুল ইসলাম বাবুর লেখা গানে কন্ঠ দিয়েছেন কুমার শানু, আশা ভোঁশলে, হৈমন্তী শুক্লার মতো উপমহাদেশের জনপ্রিয় ও কিংবদন্তিতুল্য শিল্পীরাও। সম্প্রতি তাঁকে মরণোত্তর একুশে পদক এ ভূষিত করা হয়েছে। ১৯৯০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর অকালে ঝরে যায় বাংলা গানের এই মেধাবী ও অসাধারন প্রতিভা। নতুন প্রজন্মকে আমরা আজও এমন একজন গীতিকার সম্পর্কে জানাতে পারিনি অথচ তাঁর লেখা গান এখনও দেশসেরা কণ্ঠগুলো গেয়ে থাকেন। শ্রদ্ধাঞ্জলি।