মো: তানজিম হোসাইন, শিক্ষক
শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড, আর সেই মেরুদণ্ডকে সুদৃঢ়ভাবে দাঁড় করানোর প্রধান কারিগর শিক্ষকগণ। শিক্ষকগণ রাজনীতিবিদ নন, যে প্রতিনিয়ত আন্দোলনের মাঠে সক্রিয় থাকবেন। তারা সত্যকে মিথ্যার মোড়কে উপস্থাপন করতে জানেন না। তাদের হাতে চক-ডাস্টারই মানায়, প্ল্যাকার্ড নয়। বারবার শিক্ষকদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে তাদের রাস্তায় নামতে বাধ্য করা শুধু অমানবিক নয়, এটি পুরো শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি অসম্মানের শামিল। একজন শিক্ষক, যিনি ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে তুলতে নিজের জীবনের সেরা সময়টুকু ব্যয় করেন, তার ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য রাস্তায় নামতে বাধ্য হওয়া কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তাদের প্রাপ্য সম্মান ও অধিকার দেওয়া রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব। তারা যদি হোয়াইট বোর্ড ছেড়ে রাস্তায় নামতে বাধ্য হন, তবে জাতির ভবিষ্যৎও অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে। জাতির ভবিষ্যত প্রজন্মকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে হলে শিক্ষকদের মর্যাদা এবং তাদের ন্যায্য অধিকার অবশ্যই প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
বাংলাদেশে মোট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৯৭% এমপিওভুক্ত, যেখানে পাঁচ লক্ষাধিক শিক্ষক দায়িত্ব পালন করছেন। দুঃখজনকভাবে, এই শিক্ষকগণ যে আর্থিক দুরবস্থার মধ্যে জীবনযাপন করছেন, তা তাদের ব্যক্তিগত জীবনকেই নয়, বরং দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মানকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে শিক্ষকদের মর্যাদাও সরাসরি সম্পর্কিত। এই শিক্ষকদের যথার্থ সম্মান না দিলে শিক্ষার মানও উন্নত করা সম্ভব নয়।
একজন নবীন এমপিওভুক্ত শিক্ষক প্রবেশ পর্যায়ে মাত্র ১২,৭৫০ টাকা বেতন পান। এই বেতনের মধ্যে ১,০০০ টাকা বাড়ি ভাড়া এবং ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা অন্তর্ভুক্ত। বর্তমান বাজারে এই অর্থ দিয়ে একজন শিক্ষকের পরিবার চালানো অসম্ভব। ১০০০ টাকা বাড়ি ভাড়া এবং ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা কি হাস্যকর নয়? এমন সংকটময় অবস্থায় একজন শিক্ষক তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারবেন কিভাবে? শিক্ষকদের বেতনের মধ্যে যদি মৌলিক প্রয়োজনগুলোই না মেটে, তবে তারা কীভাবে মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করবেন?
প্রতি ঈদে বেসিকের মাত্র ২৫% বোনাস দেওয়া হয়, যা শিক্ষকদের জন্য আরও এক প্রকার প্রতারণার মতো। অথচ সরকারের প্রতিশ্রুতি ছিল শিক্ষকদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য নানা পদক্ষেপ নেওয়া হবে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, অতীতের দায়িত্বশীলগণ শিক্ষকদের ন্যায্য দাবিগুলো মানার প্রতিশ্রুতি দিলেও কোনো কার্যকর পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হয়েছেন। তারা শুধু আশ্বাস দিয়েছেন, কিন্তু প্রতারণার পথে হেঁটেছেন।
এমপিওভুক্ত এবং সরকারী শিক্ষকদের মধ্যে বেতন বৈষম্য শিক্ষকদের মধ্যে যেমন ক্ষোভ সৃষ্টি করছে, তেমনই শিক্ষার্থীদের মাঝেও বিভাজন তৈরি করছে। সরকারী স্কুলে শিক্ষার্থীরা যেখানে মাত্র ১৫-৩০ টাকা মাসিক বেতন দেয়, সেখানে এমপিওভুক্ত স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থীদের ২০০ থেকে ২,০০০ টাকা পর্যন্ত বেতন দিতে হয়। অভিভাবক সমাজ এই বাড়তি খরচের বোঝা বইতে গিয়ে আর্থিক চাপের মধ্যে পড়ছেন। এই বৈষম্যের কারণে অনেক প্রতিভাবান শিক্ষার্থী শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, আর তা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে বাঁধা সৃষ্টি করছে।
জাতীয়করণের দাবি কেবল শিক্ষকদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার নয়, এটি শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিদ্যমান এই বৈষম্য দূর করারও উপায়। অভিভাবকরা চান কম খরচে তাদের সন্তানরা মানসম্পন্ন শিক্ষা পাক, যা শুধু জাতীয়করণের মাধ্যমেই সম্ভব।
এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর জাতীয়করণ শিক্ষকদের সমান বেতন কাঠামো নিশ্চিত করবে, শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষার ব্যয় হ্রাস করবে এবং অভিভাবকদের আর্থিক চাপ কমাবে। শিক্ষকগণ আর্থিক নিশ্চয়তার মধ্যে থাকলে তারা শিক্ষাদানে আরও নিবেদিতপ্রাণ হবেন এবং শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব হবে।
জাতীয়করণের প্রশ্নে রাষ্ট্রের চিন্তা-ভাবনা অত্যন্ত সুস্পষ্ট হওয়া উচিত। দেশের উন্নতি এবং শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য শিক্ষকদের জীবনের মান উন্নয়ন করা অপরিহার্য। শিক্ষা একটি দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ, যেখানে শিক্ষকদের আর্থিক সুরক্ষা ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা না হলে শিক্ষার গুণগত মান বজায় রাখা অসম্ভব। একটি উন্নত জাতি গঠনের স্বার্থে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে দ্রুত জাতীয়করণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
শিক্ষকগণ জাতি গঠনের মূল কারিগর। তাদের যথাযথ মর্যাদা এবং ন্যায্য দাবি পূরণ না হলে, দেশের শিক্ষাব্যবস্থা কেবল নামেই উন্নত হবে, কাজে নয়। শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে এবং দেশের সার্বিক উন্নয়নে শিক্ষকদের দাবি মেনে নেওয়া এখন সময়ের দাবি।
অন্যথায়, বহু বছর ধরে উপেক্ষিত যারা তারাও একদিন উপেক্ষা শুরু করবেন। মূল্য দিবে ভবিষ্যৎ। রাষ্ট্র সইবে কিভাবে?
রাষ্ট্র কি জাগবে?
মো: তানজিম হোসাইন
কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক,
বৈষম্যবিরোধী সম্মিলিত শিক্ষক সমাজ।