নিজস্ব প্রতিবেদকঃ সাভারে ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে শহীদ পরিবারের দায়ের করা ৭ হত্যা মামলায় সাভার উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান শীর্ষ সন্ত্রাসী মঞ্জুরুল আলম রাজীবের বিপরীত লিঙ্গের যৌনসঙ্গী ৫ পার্সেন্ট জাকির হোসেন ওরফে টেপা জাকির ওরফে হিজড়া জাকির ওরফে মামা জাকির ওরফে স্বর্ণ জাকির ওরফে পিস্তল জাকিরকে ডিএমপির গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সহায়তায় গ্রেফতার করেছে সাভার মডেল থানা পুলিশ।
শনিবার (১৯ অক্টোবর) রাত ৮ টায় রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে সমকামী জাকিরকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি আশুলিয়ার ইয়ারপুর ইউনিয়নের জিরাবো ফুলতলা মহল্লার আবুল হোসেনের ছেলে হলেও দীর্ঘদিন যাবত সাভারের শীর্ষ সন্ত্রাসী মঞ্জুরুল আলম রাজীবের সমকামী স্ত্রী হিসেবে সংসার ধর্ম পালন করে আসছিলেন।
শনিবার (১৯ অক্টোবর) রাতে ডিএমপির উপ-পুলিশ কমিশনার (মিডিয়া ও পাবলিক রিলেশনস) আবু তালেব এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
পুলিশ জানায়, গত ৫ই আগস্ট স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে গ্রেফতার এড়াতে রাজিবের স্ত্রী ও ছেলেকে সাথে নিয়ে ছদ্মবেশে হিজড়া সেজে পলাতক ছিলেন জাকির। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে নিহতদের স্বজনরা বেশ কিছু মামলা করেছেন। এদের মধ্যে প্রায় ৭ টি মামলায় এজাহারভুক্ত আসামি জাকির হোসেন ওরফে টেপা জাকির ওরফে হিজড়া জাকির ওরফে মামা জাকির ওরফে স্বর্ণ জাকির ওরফে পিস্তল জাকির। গণহত্যার মামলার আসামিদের গ্রেফতারে তৎপর রয়েছে পুলিশ।
শনিবার সন্ধ্যায় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে ডিবি পুলিশের সহায়তায় সাভার মডেল থানা পুলিশের বিশেষ অভিযানে সমকামী জাকির গ্রেফতার হয়।
রবিবার (২০ অক্টোবর) রাতে এ তথ্য নিশ্চিত করে সাভার মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ জুয়েল মিঞা বলেন, ‘ জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিহত পরিবারের পক্ষ থেকে হত্যা মামলা করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে নিহতের স্বজনদের দায়েরকৃত ৭ টি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। এসব মামলায় জাকিরকে গ্রেফতার দেখিয়ে রিমান্ড আবেদন করে বিজ্ঞ আদালতে প্রেরণ করা হবে বলেও জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা।
অনুসন্ধান বলছে, পাঁচ বছর আগে শীর্ষ সন্ত্রাসী মঞ্জুরুল আলম রাজীবের সম্পদ বলতে ছিল পিতার রেখে যাওয়া ১০ শতাংশ জমি। একটি টিনের ঘর। এখন হাজার কোটি টাকার মালিক। প্রতিষ্ঠা করেছেন রাজকীয় রাজ প্যালেস, রাজ রিয়েল এস্টেট এন্ড কনস্ট্রাকশন, রাজ এগ্রো, রাজ লেদার, রাজ বডি ফিটনেস সেন্টার, আইয়ান ফ্রেশ ডেইরি ফার্ম, রাজ মঞ্জুরী ভিলা, রিভার ভিউ রেস্টুরেন্ট এন্ড পার্টি সেন্টার, ইকোসিটি হাউজিং প্রকল্প, রূপকথা অ্যাপারেলস ও ওয়াসিল উদ্দিন ফাউন্ডেশন নামে প্রায় ডজন খানেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। গড়েছেন বিশেষায়িত শিল্প গ্রুপ ‘রাজ গ্রুপ’। বর্তমানে এই গ্রুপের আনুমানিক সম্পদের পরিমাণ অন্তত ২ হাজার কোটি টাকা।
আর এসবের প্রধান নিয়ন্ত্রক ছিল রাজ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাকির হোসেন ওরফে ৫ পার্সেন্ট জাকির মামা। সরকারি অফিসের সব চাঁদাবাজির টাকা জাকিরের মাধ্যমেই রাজীবের হাতে যেতো। চাঁদার প্রধান স্পট রেজিস্ট্রার অফিস। খাজনা খারিজ, হেবা দলিল, তারিখ ভুল, নাম ভুল, ব্যাকডেটে দলিল, বয়স পাল্টে দেয়া, বিআরএস রেকর্ডের ভুলেও দলিল হওয়া, মৃত ব্যক্তিকে জীবিত দেখিয়ে দলিল হতো সাভার সাব রেজিস্ট্রার অফিসে।
এখান থেকে দৈনিক প্রায় ২৫ লাখ টাকার লেনদেন হতো। চাঁদার টাকা তুলতেন আব্দুল আলিম নামে এক দলিল লেখকের সিন্ডিকেট। প্রতিদিন রাজীবের সহকারী জাকির হোসেনের কাছে প্রায় ১০ লাখ টাকা যেতো। পরে সেই টাকা রাজীবের হাতে পৌঁছাতো। এলজিইডি, জনস্বাস্থ্য, সড়ক জনপদ, শিক্ষা প্রকৌশল, পানি উন্নয়ন বোর্ড, গণপূর্ত, বিআরটিএ, বিদ্যুৎ অফিস, যুব উন্নয়ন অফিস, ভূমি অফিস, সমাজসেবা অধিদপ্তর,পরিবার পরিকল্পনা,কৃষি,মৎস্য,প্রাণী ও খাদ্য বিষয়ক উপজেলা অফিস, প্রাণিসম্পদ অফিস, ভূমি ও রাজস্ব বিষয়ক অফিসের সব ধরনের কাজে জাকিরকে ৫ শতাংশ চাঁদা দিতে হতো। চাঁদাবাজির কাজে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করতো টেপা জাকির।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, থানা পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী মঞ্জুরুল আলম রাজীবের অবৈধ অর্থ ও সম্পত্তি দেখভাল করতেন টেপা জাকির। রাজিবের ঘনিষ্ঠজন হওয়ায় তিনিও হয়ে ওঠেন কয়েকটি ফ্যাক্টরিসহ বিপুল সম্পত্তির মালিক। চলাফেরা করতেন কয়েক কোটি টাকা মূল্যের বিলাসবহুল গাড়িতে। সাভারে বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে রাজিব ও জাকিরের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। নির্বিঘ্নে ব্যবসা পরিচালনার জন্য প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের মালিককে দিতে হতো মোটা অংকের চাঁদা। চাঁদাবাজি আর দখলদারির মাধ্যমে জাকির হয়ে ওঠেন বিপুল পরিমাণ সম্পত্তির মালিক।
সাভারের বিভিন্ন পাড়া মহল্লায় ছিল রাজিবের সন্ত্রাসী বাহিনী। কেউ বড় পরিসরে ব্যবসা করতে চাইলে এই টেপা জাকিরের মধ্যস্থতায় অনুমতি নিতে হতো সন্ত্রাসী রাজীবের কাছ থেকে। অবৈধ টাকায় নির্মিত বিলাসবহুল রাজ প্যালেস ছিল জাকিরের টর্চার সেল। বিভিন্ন ব্যক্তিকে ধরে এনে নির্যাতন এবং রাজকীয় জীবনের পাশাপাশি আমোদ ফুর্তির সব ব্যবস্থাও ছিল তার সেই রাজ প্যালেসে।
প্রসঙ্গত, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীরা গত ৪ ও ৫ আগস্ট সাভারে জমায়েত হতে থাকেন। এ সময় স্বৈরাচার শেখ হাসিনার অন্যতম সহযোগী সাভার উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান শীর্ষ সন্ত্রাসী মঞ্জুরুল আলম রাজীব ওরফে বিচি বাবা এবং ঢাকা-১৯ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সাইফুল ইসলাম ওরফে ডিম সাইফুলের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন। এ ঘটনায় সাভার আশুলিয়ায় শতাধিক ছাত্র-জনতা শহীদ হন।
এমন অসংখ্য ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। শহীদের স্বজনরা পরবর্তীতে মামলা করেন। এসব মামলায় আসামিদের ধরতে তৎপর রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।