ক্রাইম রিপোর্টার কুড়িগ্রাম:
সংস্কার আর উন্নয়ন কাগজে ও কলমে, বাস্তব প্রেক্ষাপট একদম আলাদা, এর একটি জলজ্যান্ত উদাহরণ হচ্ছে কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলাধীন দলীয় ইউনিয়ন পরিষদ।
অনিয়ম আর দুর্নীতি যেন এখানকার একমাত্র নিয়ম ও নীতি। এই নীতি ও নিয়মের শুরু হয় দুলদুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী সরকারের হাত দিয়ে। পদ্যবধি দুর্দান্ত দাপটে চলছে তার তৈরিকৃত নিয়ম নামের সেই অনিয়ম। টিসিবি থেকে শুরু করে পরিষদের সকল কার্যক্রমে রয়েছে দুর্নীতির সুইস্পষ্ট ছাপ , জেনো দক্ষ কোন চিত্রশিল্পীর, নিখুত হাতের রংতুলির ছোঁয়া । এ দুর্বার দুর্নীতি অনিয়মের শেষ কোথায়? স্থানীয় সূত্রের মৌখিক এসব অভিযোগের ভিত্তিতে অনুসন্ধান নামে সাংবাদিকদের একটি টিম, অনুসন্ধান শুরু হয় ২০২৩-২৪ অর্থবছরের উপজেলা ভিত্তিক উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে, প্রায় একমাস ধরে অনুসন্ধান করে অনিয়মের অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আবিষ্কার করে সাংবাদিক টিম। অনুসন্ধানে উঠে আসে স্থানীয় সরকার নির্বাচনকালীন চিত্র। স্থানীয় সূত্র থেকে জানা যায় স্থানীয় সরকার নির্বাচন অর্থাৎ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন তিনজন, কামরুজ্জামান রানা, হাফিজুর রহমান ও লিয়াকত আলি সরকার। দলদলিয়া ইউনিয়নের স্থানীয় বিভিন্ন সূত্র বলছে হাফিজুর রহমান ও কামরুজ্জামান রানা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, লিয়াকত আলী সরকার রাজনীতিতে ছিলেন না। তিনি কিভাবে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পেলেন, এটা আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীগণই ভালো জানেন। তবে এর আগে লিয়াকত আলী সরকার কি করতেন? সূত্র থেকে জানা যায় এর আগে তিনি কৃষি ব্যাংকের কর্মকর্তা ছিলেন, দুর্নীতির দায়ে তিনি চাকরিচ্যুত হন, যার মামলা এখনো চলমান । এখানে প্রশ্ন ওঠে তার নামে মামলা থাকার পরেও তিনি কিভাবে মনোনীত হন , তিনি কি নির্বাচনী হ্লক নামায় এ তথ্য গোপন রেখেছিলেন, আর নির্বাচন কমিশন কি করে? স্থানীয় জনগণ সাংবাদিকদের বলেন, জনপ্রিয়তা ও ভোটের দিক দিয়ে হাফিজুর ভাই এগিয়েছিলেন, লিয়াকত আলী সরকার কিভাবে চেয়ারম্যান হলেন, তা আমাদের বোধগম্য নয়, স্থানীয় জনগণ আরো বলেন তিনি চেয়ারম্যান হবার পর থেকে ইউনিয়ন পরিষদ যেন অন্যায়ের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে ইউনিয়ন পরিষদ কর্তৃক নাগরিক সেবার প্রতিটি ধাপে দুর্নীতি বেড়েই চলেছে টিসিবি কার্ড প্রদানে করা হয়েছে অনিয়ম, কার্ড প্রতি নেয়া হয়েছে এক হাজার টাকা, বিনিময়ে একেই পরিবারে দেয়া হয়েছে একাধিক কার্ড, বয়স্ক ভাতা বিধবা ভাতা প্রতিবন্ধী ভাতা ভিজিডি কার্ড, সব ক্ষেত্রেই রয়েছে আর্থিক বিনিময়ে ১০০০ থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত, এ আর্থিক বিনিময় হতো চেয়ারম্যানের ভাতিজা থেতরাই বাজারের ওষুধ ব্যবসায়ী মোঃ মাইদুল ইসলাম, ও চেয়ারম্যানের ভাই মোঃ আলতাফ হোসেন, চেয়ারম্যানের আরেক ভাতিজা মোঃ আপেল এর সাথে, আর্থিক লেনদেন হয়।
স্থানীয় জনতা আরো বলেন, চেয়ারম্যান এর কাছে কোন কাজের জন্য গেলেই তিনি ভাতিজা মাইদুল ইসলামের কাছে পাঠিয়ে দেন, এমন মনে হতো যে মাইদুল ইসলামই যেন দলদলীয় ইউনিয়ন পরিষদের অলিখিত চেয়ারম্যান, এরপর সাংবাদিকদের টিম অনুসন্ধান শুরু করে ২০২৩-২৪ উপজেলা ভিত্তিক উন্নয়ন প্রকল্প টিআর কাবিখা, কাবিটা, ও এমপির বরাদ্দ প্রকল্প নিয়ে, অনুসন্ধানে দেখা যায় দলদলীয় ইউনিয়ন পরিষদের ২৩-২৪ অর্থবছরে টিআর এবং এমপির বরাদ্দ থেকে মোট ৩২ টি প্রকল্প পেয়েছে, তার মধ্যে টিআর এর কিছু কিছু কাজ হয়েছে, কিন্তু এমপির বরাদ্দের টাকা পুরোটাই গেছে লুটের পেটে, প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি বিশ্লেষণ করে ২১ জন ব্যক্তির নাম পাওয়া যায় ।
এরা হলেন, মাহফুজার, মমিনুর রহমান, আশরাফ আলী, নূরে আলম, খলিলুর রহমান, রায়হান আলী, রবিউল ইসলাম, লোকমান হাকিম, মোসলেম, দেলোয়ার, বেলাল হোসেন, ময়নাল হক, মান্নাত আলী, দুলাল খাঁ, মোজাফফর রহমান, নূর মোহাম্মদ, ইমদাদুল হক, নুর ইসলাম, আইয়ুব আলী এবং মোহাম্মদ আলী, প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটিগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সব প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটিতে ঘুরে ফিরে এই ২১ জনের নাম । যা স্পষ্ট করে যে এরা প্রকল্প আত্মসাৎ কারী সিন্ডিকেট। আরো গভীরভাবে অনুসন্ধান করে পাওয়া যায়, এরা সকলেই লিয়াকত চেয়ারম্যানের আত্মীয়-স্বজন এবং আওয়ামী অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মী ও সদস্য । অনুসন্ধানে আরো দেখা যায় একই প্রকল্প বিভিন্নভাবে ঘুরেফিরে ভিন্ন নামে একাধিক প্রকল্প করা হয়েছে, বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে কিন্তু কাজ হয়নি, যেমন খামার মাগুরা সরকারপাড়া জামে মসজিদ বাউন্ডারি ওয়াল নির্মাণ কাজ বরাদ্দ, ১ লক্ষ ১৬ হাজার ২৩০ টাকা, এবং খামার মাগুরা সরকার পাড়া ঈদগা মাঠে বাউন্ডারি ওয়াল বরাদ্দ এক লক্ষ টাকা, একটি প্রতিষ্ঠান দুটি নাম দুটি প্রকল্প কাজ হয়নি একটারও, ৫ নং ওয়ার্ডের সাজুর বাড়ি থেকে শিরিনের বাড়ি রাস্তা সংস্কার বরাদ্দ ৩ লক্ষ টাকা, মিয়াপাড়া হাবিবুর এর বাড়ি থেকে সজলুলের বাড়ি রাস্তা সংস্কার কাজ বরাদ্দ পাঁচ লক্ষ টাকা, এখানেও কোন কাজ হয়নি, তবে প্রকল্প বরাদ্দের টাকা কি হয়েছে ? স্থানীয় একটি সূত্র বলেছে, মঙ্গার ১০০ দিনের মাটিকাটা কর্মসূচি ছাড়া আর কোন প্রকল্পের কাজ হয়নি ।
এ বিষয়ে পিআইও অফিস সহকারী কামঃ কম্পিউটার অপারেটর মোঃ মেহেদী বলেন, পিআইও স্যার একা মানুষ প্রকল্প ভিজিটের সময় পায় না, অফিস সহকারীর এমন মন্তব্যের ব্যাপারে পিআইও সিরাজউদ্দৌলাকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, মেহেদী ঠিক বলেছে আমি প্রকল্প ভিজিট করার সময় পাইনা, আর এসব প্রকল্প নিয়ে কি হয়েছে তা আমিও জানি, আপনারাও জানেন, পিআইও সাংবাদিকদের এটা কিসের ইঙ্গিত দিলেন?
প্রজাতন্ত্রের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা রাষ্ট্রের অর্থ লুট করতে কিভাবে সহায়তা করেছে, তা সচিত্র প্রমাণ মিলে, পি আইও এর মন্তব্যে ।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার আতাউর রহমান বলেন, আমি প্রতিটি প্রকল্প ভিজিট করে অর্থ প্রদান করেছি সেখানে পিআইও কেন ভিজিট করবে না, এটার কোন সুযোগ নেই। তবে ইউএন’ও এর মন্তব্যের সাথে বাস্তবে কোন মিল নেই।
সাংবাদিক টিম এবার অনুসন্ধান শুরু করে ২০২২ এর বন্যা কবলিত নদী ভাঙ্গন এলাকায়, নদী ভাঙ্গন প্রকল্প ২০২২ এর বরাদ্দের পরিমাণ এবং প্রকল্পের সুবিধা ভোগীদের এখানেও দুর্নীতি ও স্বজন প্রীতির চিত্র, প্রকল্পের সুবিধা দিতে প্রাথমিকভাবে ৪০০ পরিবারের তালিকা করা হয়, সেখান থেকেও ৩৫ পরিবারকে প্রকল্প সুবিধা দেয়ার জন্য নির্বাচিত করা হয়, নেয়া হয় খরচ বাবদ ৫ হাজার টাকা, দলদলিয়া অর্জুন এলাকার সমেদ আলী (৫৫) বলেন, প্রথমে আমার ব্যাংক একাউন্ট করার জন্য চেয়ারম্যানের ভাতিজা মাইদুল আমার নিকট ৫০০ টাকা নেয় এবং পরবর্তীতে অন্যান্য খরচ বাবদ আরো ৫ হাজার টাকা নেয়, যেদিন ব্যাংক থেকে টাকা ওঠায় ব্যাঙ আমার হাতে ৭৫ হাজার টাকা দিয়েছিল কিন্তু ব্যাংক থেকে বের হওয়ার পর চেয়ারম্যানের লোকজন আমাকে একটি আলাদা কক্ষে নিয়ে গিয়ে আমার হাতে ৩০ হাজার টাকা ধরিয়ে দেয়।
কথা হয় ৬০ বছর বয়সী বৃদ্ধ গনি মিয়ার সাথে জানতে চাওয়া হয় তোমার বাড়ি কোনটে বাহে, তোমার বাড়ি কি নদী ভাঙ্গে নাই, জবাবে বলেন ৬ থেকে ৭ বার ভাঙছে বা । কোন অনুদান পান নাই বাহে, জবাবে তিনি বলেন, হামাক কাই টাকা দিবে হামাকে চেয়ারম্যান চেনে না, চেয়ারম্যানের সাগাই যাই তাকে টাকা দিবে। তথ্য অনুসন্ধানে দেখা যায় একই পরিবারে তিনজনকে এ প্রকল্পের আওতায় ১০ হাজার করে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে অর্থাৎ দু একজন ব্যক্তি ছাড়া বাকি সকল সুবিধা ভোগী কে পাঁচ থেকে দশ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে । সুবিধাভোগীরা জানেনা এ বরাদ্দ কিসের কি পরিমান, আর কত করে পাচ্ছে । অর্থাৎ পুরো বিষয় পর্যালোচনা করলে স্পষ্টত সুকৌশলে ২০২২ এর নদী ভাঙ্গন প্রকল্প থেকে ২২ থেকে ২৩ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। স্থানীয় জনগণের পক্ষ থেকে আমিন হোসেন, দেলোয়ার হোসেন, আব্দুল মালেক, আব্দুল খালেক, মুকুল হোসেন, আব্দুল গনি, কছির উদ্দিন, আকবর আলি, মালেকা বেগম, আমেনা বেগম, ফাতেমা বেগম, সাইদুল ইসলাম, আব্দুছ সোবহান, আব্দুস সালাম, মুরাদ, সাজু মিয়া, মেহেরুল আলম, মনোয়ারা বেগম, আবুল হোসেন, আনিসুর রহমান, মমিনুল এবং মুসা, সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন।
তারা বলেন, লিয়াকত আলী সরকার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই নিকট আত্মীয় স্বজনদের মাধ্যমে বিভিন্নভাবে দুর্নীতি করে আসছে। গড়েছে কালো টাকার পাহাড়। তার স্বেচ্ছাচারিতা ও অনিয়মে অতিষ্ট হয়ে ইউপি সদস্যগণ ২২/০৩-২৩ ইং তারিখে চেয়ারম্যানের উপর অনাস্থা প্রস্তাব আনেন কিন্তু রাজনৈতিক ও বেশি শক্তির প্রভাবে তারা অনাস্থা প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করতে বাধ্য হন। আমরা সাধারণ জনগণ এই দুর্নীতিবাজ স্বেচ্ছাচারিতা চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ পূর্বক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট আকুল আবেদন করছি।
এ বিষয়ে চেয়ারম্যান মোঃ লিয়াকত আলী সরকার এর সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি সাংবাদিক পরিচয় পাওয়া মাত্রই ফোন কেটে দেন।
রফিকুল ইসলাম রফিক
কুড়িগ্রাম জেলা প্রতিনিধি