মোঃ আজগার আলী, জেলা প্রতিনিধি সাতক্ষীরা:
শীতের দিনে ঘানি ভাঙা সরিষার তেল গায়ে মাখলে অল্পতেই শরীর গরম হয়ে যায়। শীতও কম অনুভূত হয়। আর মুড়ির সাথে চানাচুর মেখে খেতে এ তেলের কোনো জুড়ি নেই। ঘানি ঘোরানো খাঁটি সরিষার তেল দিয়ে আলু, বেগুন, উচ্ছে, ডালসহ বিভিন্ন প্রকার ভর্তা খাওয়ার মজাটাই আলাদা।
গ্রামীণ জনপদে সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুদের সারা শরীরে খাঁটি সরিষার তেল লাগানোর রেওয়াজ এখনও বিদ্যমান। একই সাথে মানুষের মাথার খুশকি দূর করতে এই তেলের গুনাগুন অপরিহার্য। অথচ সময়ের ব্যবধানে সাতক্ষীরার পাটকেলঘাটায় আধুনিকতার ছোয়ায় কালের গর্ভে হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রাম বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য ঘানি শিল্প।
সূত্র জানায়, এক সময় সল্প ব্যয়ে কম খরচে বহু বাড়িতে তৈরী করা হতো খাঁটি সরিষার তৈল। বর্তমান আধুনিক প্রযুক্তির প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে না পারায় এ শিল্প এখন বিলুপ্ত প্রায়। গ্রাম বাংলার এই শিল্প এখন আর তেমন দেখা যায় না। উপজেলায় হাতে গোনা দু-একটা গ্রামে এ শিল্প টিকে আছে। বর্তমান প্রজন্মের কাছে এ শিল্প যেন নানা-দাদা গল্পের ঝুলি বলে মনে হয়। এখন আর ঘানিতে ঘুরানো খাঁটি সরিষার তৈল পাওয়া অনেকটা কষ্টসাধ্য। ঘূর্ণন যন্ত্র দারা ঘানিতে গরুর সাহায্যে সরিষা জাতীয় তৈল বীজ থেকে বের করা হয় তেল। ঘানি টানার জন্য গরুর দু’চোখ বেঁধে ঘোরানো হয়। যে যন্ত্রের সাহায্যে কোন তৈল বীজকে নিষ্পেষণ করে তেল বের করা হয় তাকে ঘানি বলে। তৈল নিষ্পেষন একটি প্রাচীন জীবিকা। এই পেশার লোকদের কে কলু বলা হয়। ঘানি টানা খুব পরিশ্রমের কাজ তাই আগেকার দিনে কারাদন্ড প্রাপ্ত লোকদের দিয়ে ঘানি ঘোরানো হতো। তাই তো প্রবাদ মতে, জেল-হাজতে যাওয়াকেই অনেক সময় জেলের ঘানি টানছে এমন কথা বলা হয়ে থাকে।
বর্তমান প্রযুক্তির কাছে হার মানতে বাধ্য হয়েছে প্রাচীন ইতিহাস ঐতিহ্যের সেই ঘানি। বর্তমানে খাঁটি ঘানির প্রতি কেজি সরিষার তেলের দাম ৪০০ টাকা। কিন্তু সে তুলনায় মেশিনের তেল ২০০ টাকা কেজি দরে যদিও বিক্রি হচ্ছে। তবে সেই তেলের গুণগত মান নিয়ে জনমণে রয়েছে নানান প্রশ্ন। তারপরও অনিবার্য কারণবশত নিত্য নতুন প্রযুক্তির কাছে ঘানি আজ হার মানতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে এ শিল্প টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তালা উপজেলার পাটকেলঘাটা বাজার সংলগ্ন দাইপাড়া মোড় নামক স্থানে পুরান ঐতিহ্য ঘানি শিল্পটি আজও টিকে থাকলেও বর্তমানে যন্ত্রাংশ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় কাজ বন্ধ হয়ে গেছে।
ইয়াছিন সরদার বলেন, আমার দাদাদের আমলের এ শিল্প প্রায় বিলীন হওয়ার পথে। জোড়াতালি দিয়ে কোন রকমে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। এখন এই ঘানি আঠারো মাইল বেতা গ্রামের আমার নানা আহম্মদ আলী গাজী ও পাটকেলঘাটায় আমাদের ছাড়া এলাকায় আর কোন ঘানি নেই। এ শিল্পে লোকবল কম লাগে। কম খরচে প্রাচীন আমলের সেই ঘানির মাধ্যমে খাঁটি তেল বের করা হয়। প্রতিদিন ঘানিতে ৪ থেকে ৬ কেজি তেল বের করা হয়। এই তেলের চাহিদা অনেক। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী তেল সরবরাহ করা সম্ভব হয় না। প্রতি কেজি তেল ৪শ’ টাকায় বিক্রি করা হয়। খাঁটি সরিষার তেল নিতে দূর দুরান্ত থেকে লোক আমাদের এখানে আসে। কথা হয় পাটকেলঘাটার তৈলকুপি গ্রামের রাধাপদ সাধুর সাথে সে জানায় ঠাকুর দাদারা ঘানির সাথে যুক্ত থেকে অনেক কিছু করেছে। আমাদের কাছে ঘানি এখন রূপ কথার গল্পের মত।
পাটকেলঘাটা পশ্চিম পাড়া গ্রামের আবুল কালাম গাজী জানান, অনেক আগে থেকেই আমরা এ পেশা ছেড়ে দিয়েছি। আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহারের সাথে এ শিল্প টিকে থাকতে পারেনা। তাছাড়া এ পেশা লাভ জনকও না। বর্তমানে আমরা অন্য ব্যবসা বানিজ্য করে ভাল আছি।
ডাঃ হরিপদ দাশ বলেন, ঘানির তেলে বৈজ্ঞানিক অনেক উপসর্গ রয়েছে। এতে রয়েছে বিটা ক্যারোটিন, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন, আলফা ওমেগাথ্রি, সিক্স ফ্যাটি অ্যাসিড, আয়রন, ম্যাংগানিজ এবং অ্যান্টি-অ্যাক্সিডান্ট। যা শরীরের জন্য অনেক উপকার।
তালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মো. রাসেল বলেন, আবহমান বাংলার ঐতিহ্যের সাথে জড়িত ঘানি শিল্পকে টিকিয়ে রাখা আমাদের দায়িত্ব। বিষযটি খোঁজ খবর নিয়ে দেখবো সরকারের কোন দপ্তর এটার সাথে সংশ্লিষ্ট। অবশ্যই ব্যবস্থা নিব যাতে এ শিল্প টিকে থাকে।