মোঃ আজগার আলী, সাতক্ষীরা:
১৯৭১ সালের তেজস্বী গৌরব-গাঁথায় বাঙালি জাতির অবিস্মরণীয় কীর্তি স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয় অর্জনে সাতক্ষীরার ভূমিকা অত্যন্ত মহিমান্বিত। মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতিকে বিশ্ব দরবারে বীরত্বের নিদর্শনে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সাহস শক্তি ও শিক্ষা দিয়েছে। এ মর্যদার আসন অর্জন করতে ৩০ লক্ষ জীবন এবং ২ লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রমের সর্বোচ্চ ত্যাগ আর মূল্য দিতে হয়েছে, যা কখনোই পরিশোধ যোগ্য নয়। তাদের সেই সংগ্রাম আর আত্মহুতির মাধ্যমে আমরা বংশপরম্পরায় স্বাধীনতার সুফল ভোগ করে চলেছি। আজকের এই দিনে আমরা আমাদের সেইসব জীবন উৎসর্গ করা স্বজন, জাতীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা ও আত্মত্যাগীদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে সাতক্ষীরা তথা ৮ ও ৯নং সেক্টরের মুক্তিযুদ্ধের ভুমিকা ও গুরুত্ব অপরিসীম। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম সুন্দরবন সীমান্ত অঞ্চলের বীর মুক্তিযোদ্ধাগণের দক্ষতাপূর্ণ গেরিলা এবং সম্মুখযুদ্ধের ফলে সুন্দরবনসহ উপকূলীয় শ্যামনগর, কালিগঞ্জ, দেবহাটা, ভোমরা অঞ্চল ১৯৭১ সালের ২৩ নভেম্বরের মধ্যে পাক হানাদার মুক্ত হয়। দীর্ঘ নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে সেদিনের সাহসী সন্তানরা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল। পাক হানাদার ও তাদের দোসররা মা-বোনের ইজ্জতহরণ করেছিল। ধ্বংস করতে চেয়েছিল বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে। শত্রুর বুলেটের এত সব আঘাত সহ্য করেও সাতক্ষীরার মুক্তিকামি দামাল সন্তানরা প্রায় অর্ধশতাধিক যুদ্ধের মোকাবিলা করেছিল। এরমধ্যে ১৬টি যুদ্ধ বিশেষভাবে স্পর্শকাতর ও উল্লেখযোগ্য ছিল। সাতক্ষীরা শহর মুক্ত করতে বীর মুক্তিযোদ্ধারা প্রবল পরাক্রমে চারদিক থেকে সাতক্ষীরা শহরে গেরিলা হামলা চালায় এবং রাস্তায় ট্যাংক বিধ্বংসী মাইন পেতে পাকসেনাদের খতম ও বিভ্রান্ত করে তোলে। ফলে ভারতীয় মিত্র সেনাবাহিনী বাংলাদেশে ঢোকার পূর্বেই মুক্তিযোদ্ধাগণের প্রতাপী পরাক্রমের মুখে সাতক্ষীরা শহর পাকহানাদার মুক্ত হয়। এটি নিঃসন্দেহে মুক্তিযুদ্ধের একটি ব্যাতিক্রমি অবদানের অংশিদার।
মুক্তিযোদ্ধা কাজী রিয়াজ জানান ১৯৭১ সালের ২ মার্চ সাতক্ষীরা শহরে পাকিস্তানবিরোধী মিছিলে রাজাকাররা গুলি করে হত্যা করে শহীদ আব্দুর রাজ্জাককে। আর এখান থেকে শুরু হয় সাতক্ষীরার দামাল ছেলেদের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া। মুক্তিযুদ্ধের খরচাদি বহনের জন্য সাতক্ষীরা ট্রেজারী হতে অস্ত্র লুট আর ন্যাশনাল ব্যাংক হতে অলংকার টাকা পয়সা লুট করে কেন্দ্রীয় সমন্বয় ফান্ডে জমা দেওয়ার কৃতিত্ব থেকে শুরু হয় এ মুক্তি সংগ্রামের প্রেক্ষাপট। লাইটের আলোয় অসুবিধা হওয়ায় ৩০ নভেম্বর টাইম বোমা দিয়ে শহরের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত পাওয়ার হাউস উড়িয়ে দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের ভীত সন্ত্রস্ত করে ফেলে। পাওয়ার হাউজ উড়িয়ে দেওয়ার এ মিশনে নেতৃত্ব দেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মালেক সোনা ও মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ। রাতের আঁধারে বেড়ে যায় গুপ্ত হামলা। মুক্তিযোদ্ধাদের এহেন হামলায় টিকতে না পেরে ৬ ডিসেম্বর রাতে পাকসেনারা পিছু হটতে শুরু করে। বাঁকাল, কদমতলা ও বিনেরপোতা ব্রিজ উড়িয়ে দিয়ে পাক বাহিনী সাতক্ষীরা থেকে পালিয়ে যায়। যুদ্ধকালীন সময়ে শত্রুদের গুলিতে শহীদ হন আব্দুর রাজ্জাক, কাজল, খোকন, নাজমুল, হাফিজউদ্দিন, নুর মোহাম্মদ, আবু বকর, ইমদাদুল হক, জাকারিয়া, শাহাদাত হোসেন, আব্দুর রহমান, আমিনউদ্দিন গাজী, আবুল কালাম আজাদ, সুশীল কুমার, লোকমান হোসেন, আব্দুল ওহাব, দাউদ আলী, সামছুদ্দোহা খান, মুনসুর আলী, রুহুল আমীন, জবেদ আলী, শেখ হারুন অর রশিদসহ সাতক্ষীরার ৩৩ জন বীর সন্তান । এ প্রসঙ্গে সাতক্ষীরার কয়েকটি বিশেষ বিশেষ স্পটের পাক-হানাদার মুক্তির স্বতন্ত্র প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করা হলো ঃ
শ্যামনগর মুক্ত: বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্রমাগত পরিকল্পিত হামলার ফলে ১৯৭১ এর ১৯ নভেম্বর সুন্দরবন সংলগ্ন শ্যামনগর উপজেলা থেকে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ওই অঞ্চল থেকে প্রথমে হটে যেতে বাধ্য হয়। এখানে বেশ কয়েক জন পাকসেনা নিহত হয়। এ বিষয়ে মুজিবনগর সরকার ফোর্স কার্যালয়ের যুদ্ধ বুলেটিং এ উল্লেখ করা হয়েছে, ” Mukit Bahini is now in cnntrol of Kaligonj. On November 19, Mukti Bahini advanced towards SHYAMNAGAR and after minor exchange of fire,Mukti Bahani advanced towards NOORNAGAR and drove the occupation troops. On the same day Mukti Bahini raided SANKERKATI and after heavy fight they captured it. Acceding to latest report intensive fight is continuing all around Satkhira, a subdivisonal Town of Khulna district.” ‘তথ্যসূত্রঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র’- একাদশ খ-, পৃষ্ঠা- ১৫৯/১৬০।
কালিগঞ্জ মুক্ত: ১৯৭১ এর ২০ নভেম্বর বসন্তপুর, নাজিমগঞ্জ ও কালিগঞ্জে ক্যাপ্টেন্ট নুরুল হুদার কমা-ে পাকবাহিনীর সাথে তুমুল যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে টিকতে না পেরে কালিগঞ্জ অঞ্চল থেকে পাকিস্তান আর্মি পিছু হটে দেবহাটা উপজেলার পারুলিয়া অভিমুখে চলে যায় কালীগঞ্জের যুদ্ধে পাকবাহিনী বহুগোলা-বারুদ ও সৈন্য হারিয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়। এ সময় বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ পুরা অঞ্চল দখলে নেয়। অর্থাৎ ২০ নভেম্বর কালিগঞ্জ অঞ্চল পাক হানাদার মুক্ত হয়। দিনটি ছিল পবিত্র ঈদের দিন। সীমানা ঘেঁষা এই উপজেলার বসন্তপুর, রতনপুর, মৌতলা, কালিগঞ্জসহ সীমান্তের অনেক স্থানে বিভিন্ন ভাবে মুক্তিযোদ্ধাগণ কখনো গেরিলা হামলা, কখনো সন্মুখ যুদ্ধ করে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসর রাজাকার বাহিনীকে বিধ্বস্ত করে। ২০ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল আক্রমণের মুখে সৈন্য হারিয়ে, গোলাবারুদ ফেলে পাকবাহিনী কালিগঞ্জ অঞ্চল ছেড়ে পালিয়ে যায়। Mukti Bahini raided the occupation troops position in BASANTAPUR of Kaliganj Police Station under Satkhira Subdivision on 20th November. After the whole day fight Mukti Bahini captured BASANTAPUR. On the same day Mukri Bahini continued advancing towards KALIGANJ Police Station. After heavy exchange of fire and suffering casualties the occupation troops retreated from Kaliganj. (‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র’ একাদশ খ-, পৃষ্ঠা-১৫৯)। ৯নং সেক্টরের অন্যতম যুদ্ধপরিচালনাকারী ক্যাপ্টেন নুরুল হুদা সহস্রাধিক বীর মুক্তিযোদ্ধার সমাবেশের মাধ্যমে কালিগঞ্জে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। এই সাফল্যকে ধারে রাখতে কালিগঞ্জ থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ডাকটিকিট প্রকাশিত হয়।
দেবহাটা মুক্ত: সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিল এর নির্দেশে ক্যাপ্টেন নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন যোদ্ধাগণ দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে অগ্রবর্তী পাক ঘাটি দেবহাটায় আক্রমন চালানোর জন্য অগ্রসর হয়। এদিকে টাউনশ্রীপুর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প থেকে অনারারী ক্যাপ্টেন মাষ্টার শাহজাহান তাঁর বাহিনী নিয়ে মাঝ পথে আক্রমন চালায়। পাক-হানাদাররা দিশাহারা হয়ে পারুলিয়া ব্রিজ ধ্বংস করে দিয়ে কুলিয়া ব্রিজের উত্তর পাড়ে অবস্থান গ্রহন করে। ক্যাপ্টেন নুরুল হুদা তাঁর বাহিনী নিয়ে ৪ মাইল দূরে অবস্থান নেয়। লেপ্ট্যানেন্ট মাহফুজ আলম বেগ জানান- তিনি ‘রাতের অন্ধকারে কয়েক জন গেরিলা যোদ্ধা নিয়ে পাকসেনাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ডিনামাইট দ্বারা কুলিয়া-শ্রীরামপুর ব্রিজ ভেঙে দেন, এখানে কয়েকজন পাক-টহল সেনা নিহত হয়। ‘এখানে ত্রিমুখী যুদ্ধে হানাদার সৈন্য, গোলাবারুদ হারিয়ে টিকতে না পেরে পিছু হটতে বাধ্য হয়।
কুলিয়া মুক্ত: ২৩ নভেম্বরের মধ্যে কুলিয়া, ভোমরাসহ আলীপুর অঞ্চল পাক-হানাদার মুক্ত হয়। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ফোর্স হেড কোয়ার্টারের ২৩ নভেম্বর /১৯৭১ এর যুদ্ধ বুলেটিং এ উল্লেখ আছে- In Khulna Sector Mukti Bahini yesterday captured enemy position at BHOMRA and KHULIA. Fearing to be cutoff the Pakistani army has vacated Satkhira town During their raid in Kulia area Mukti Bahini killed 12 enemy soldiers. তথ্যসূত্রঃ স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র ১১তম খ-, পৃষ্ঠা-১৬০। সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিল তাঁর সীমাহীন সমর গ্রন্থে বলেছেন ২৩ শে নভেম্বর পারুলিয়া থেকে চার মাইল দূরে আর একটা ব্রীজের পিছনে হানাদাররা সরে গেল। আমাদের সেন্যরা সামনের দিকে অগ্রসর হতে লাগলো। নবম সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাগণের নিরাপদ ঘাটি ছিল ভারতের হিজলগঞ্জ, হাসনাবাদ, টাকী, সমশেরনগর। সেখান থেকে দলে-দলে মুক্তিযোদ্ধা মাতৃভূমিতে ঢুকে ক্ষুধার্ত বাঘের ন্যায় পাক আর্মি ও তাদের দোসর রাজাকার আলবদরদের উপর হামলা চালায়।
ভোমরা মুক্ত: ৮ম ও ৯ম সেক্টরের অধীনে ভারতের বিভিন্ন এলাকায় ট্রেনিং শেষে ২৭ মে সাতক্ষীরার ভোমরা সীমান্তে প্রথম সম্মুখ যুদ্ধ শুরু হয়। এ সময় পাক সেনাদের দু’শতাধিক সৈন্য নিহত হয়। ১৭ ঘণ্টাব্যাপী এ যুদ্ধে শহীদ হন তিন জন মুক্তিযোদ্ধা এবং আহত হন আরও দুই মুক্তিযোদ্ধা। এরপর থেমে থেমে চলতে থাকে সাতক্ষীরার বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের গুপ্ত হামলা ও সম্মুখ যুদ্ধ। এসব যুদ্ধের মধ্যে ভোমরা, টাউন শ্রীপুর, বৈকারী ও খানজিয়া উল্লেখযোগ্য। যুদ্ধে পরাজিত হয়ে হানাদার বাহিনী সাতক্ষীরা অভিমুখে পালিয়ে গিয়ে বাঁকাল ব্রীজের পাশে অবস্থান গ্রহন করে। মেজর এম,এ জলিলের ‘সীমাহীন সমর’ গ্রন্থ থেকে জানা গেছে, ক্যাপ্টেন নুরূল হুদা, মিঃ চৌধুরী, ও শাহজাহন মস্টারের নেতৃত্বাধিন মুক্তিবাহিনী ও তাদের লোকজন একত্র করে আটটি কোম্পানিতে বিভক্ত করে যুদ্ধ পরিচালিত হয়। লেঃ মোহাম্মদ আলী, লেঃ আহসানউল্লাহ, লেঃ শচীন এবং চৌধুরীকে নেতৃত্বের দায়িত্ব দিয়ে সাতক্ষীরার অভিমুখে অগ্রসর হয়ে যুদ্ধের নির্দেশ প্রদান করা হয়। তিনি উল্লেখ করেছেন- “২৩ নভেম্বর চার মাইল দুরে আর একটা ব্রিজের পিছনে হানাদাররা সরে গেল।” অর্থ্যাৎ পাকআর্মিরা বাঁকাল ব্রিজের সাতক্ষীরা পারে অবস্থান নেয়। সুতরাং এটি স্পষ্ট যে, ২৩ নভেম্বরের মধ্যে ১৯৭১ সীমান্তবর্তী দেবহাটা, কুলিয়া, ভোমরা, আলীপুর অঞ্চল পাক-হানাদার মুক্ত হয়। এর পর তারা বাঁকাল ব্রিজ ভেঙে দিয়ে সাতক্ষীরার পারে ঘাটি গাড়ে। একে একে মুক্ত হতে থাকে সাতক্ষীরর সীমান্ত সংলগ্ন গোটা অঞ্চল।
এপর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাগণ প্রবল মানসিক পরাক্রমে চারদিক থেকে সাতক্ষীরা শহরের গেরিলা হামলা চালায় এবং রাস্তায় ট্যাংক বিধ্বংসী মাইন পেতে পাকসেনাদের খতম ও বিভ্রান্ত করে তোলে। ফলে ভারতীয় মিত্র সেনাবাহিনী বাংলাদেশে ঢোকার পূর্বেই মুক্তিযোদ্ধাগণের পরাক্রমের মুখে সাতক্ষীরা শহর পাকহানাদার মুক্ত হয়। বলা হয়েছে, In this engagement 3 enemy soldiers including one captain were killed and the jeep was destroyed. SATKHIRA Town is now isolated from the rest of KHULNA District, it is learnt. (সূত্রঃ স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র ১১তম খ-,পৃষ্ঠা-১৬৩) দীর্ঘ পরাধীনতার পর এ অঞ্চলের মানুষ প্রথম গ্রহন করে মুক্ত বাতাস। বাংলাদেশ ফোর্স হেডকোয়ার্টারের ২৩ নভেম্বর ১৯৭১ এর যুদ্ধ বুলেটিন এ উল্লেখ করা হয়েছে In Khulna Sector, Mukti Bahini yesterday captured enemy position at BHOMORAR and KHULIA. Fearing to be cut off the Pakistani Army has vacated Satkhira town. During their raid in Kulia area, Mukti Bahini killed 12 enemy soldiers. (সূত্রঃ স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিল পত্র ১১তম খ-, পৃষ্ঠা-১৬০)। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে নিঃসন্দেহে বলা যায় ১৯৭১ এর নভেম্বর মাসের ১৯ তারিখ থেকে ২৩ তারিখের মধ্যে সুন্দরবন উপকূলীয় শ্যামনগর থেকে ভোমরা বর্ডারসহ বাঁকাল পর্যন্ত পাকহানাদার মুক্ত করে নবম সেক্টরের যোদ্ধাগণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছেন। এই অসাধারণ ভুমিকা দেশের অন্যান্য অঞ্চলের বীর মুক্তিযোদ্ধাগণকে যুদ্ধজয়ে আত্মপ্রত্যয়ী করে তুলতে সক্ষম হয়েছে এবং ভুক্তভোগী দেশী-বিদেশী স্বাধীনতাকামী কোটি-কোটি জনতাকে বাংলাদেশ স্বাধীনের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদান করেছে। এরপর সারাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ জয়ের আকাঙ্খা বেড়ে যায়।
এদিকে নবম ও অষ্টম সেক্টরের যোদ্ধাগণ দলে দলে আনাড়ি পথে সাতক্ষীরা শহর ও সংলগ্ন অঞ্চলে ঢুকে পড়ে এবং শহরের খুলনা এবং যশোরগামী সড়কের দু’পাশে পাক বাহিনীর সুরক্ষিত বাংকারে ক্রমাগত কখনো গেরিলা, কখনো সম্মুখ হামলা চালানোর ফলে পাকিস্তানী আর্মিরা সাতক্ষীরা শহর, থেকে ছাউনি গোঠাতে বাধ্য হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের ট্যাংক ধ্বংসকারী মাইন ব্যবহারের পর ভীত হয়ে পাকিস্তান আর্মির একটি অংশ কলারোয়ার হয়ে যশোরের পথ ধরে এবকং অন্য একটি অংশ বিনেরপোতা ব্রিজ ভেঙে দিয়ে প্রাণ ভয়ে চুকনগর-খুলনার পথ ধরে বেরিয়ে যায়। সাতক্ষীরা যুদ্ধে বেশ কয়েকজন পাক আর্মি অফিসার এবং সৈন্য নিহত হয় ও তাদের গাড়ি ধ্বংস হয়। এই অবস্থায় অস্ত্র-সস্ত্র, গোলাবারুদ ফেলে তারা পশ্চাৎপদ অনুস্মরণ করে। মেজর এম এ জলিল উল্লেখ করেছেন ‘ডিসেম্বর ১৯৭১ এর তিন তারিখের মধ্যে পাকসেনারা সাতক্ষীরা শহর ছেড়ে চুকনগর-দৌলতপুর রাস্তা ধরে খুলনার পথে রওনা হয়। তিনি উল্লেখ করেছেন আমাদের মুক্তিবাহিনী ডিসেম্বর মাসের ৩ তারিখে সাতক্ষীরা অধিকার করে সাতক্ষীরা-দৌলতপুর রোড ধরে অগ্রসর হতে লাগলো। এইভাবে মিত্রবাহিনী পাকিস্তান আর্মির বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ যুদ্ধ শুরু করার পূর্বেই মুক্তিযোদ্ধাগণের যুদ্ধে হানাদার মুক্ত হয় সীমান্তবর্তী তৎকালীন মহাকুমা শহর সাতক্ষীরাসহ এর অন্যান্য সীমান্ত অঞ্চল। আমাদের দৃষ্টিতে যুদ্ধজয়ের মাধ্যমে হানাদার মুক্ত অঞ্চল হিসেবে বাংলাদেশের সুন্দরবনসহ উপকূলীয় সাতক্ষীরা অঞ্চলই একক বৃহৎ পাক-হানাদার মুক্ত স্বাধীন ভূুখন্ড।
কর্ণেল ওসমানীর মুক্তাঞ্চল পরিদর্শন: স্বাধীনতার এই ঊষালগ্নের কথা বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচারিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের সেক্টরস অধিনায়ক কর্ণেল এম এ জি ওসমানী ২৬ নভেম্বর ১৯৭১ সাতক্ষীরার হানাদার মুক্ত স্বাধীন দেবহাটা কুলিয়া অঞ্চল পরিদর্শন করেন এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহিত করেন। এ সময় তাঁর একান্ত সচিব, ক্যাপ্টেন শেখ কামাল ও অন্যান্য সমর নায়কগণ উপস্থিত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের নবম সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিল, ক্যাপ্টেন নুরুল হুদা সহ অন্যান্য সামরিক কর্তাগণ তাকে অভ্যর্থনা জানান। এক পর্যায়ে স্বাধীন ও মুক্তঞ্চল দেবহাটায় মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা হয়।
প্রবাসী সরকার মন্ত্রীর সাতক্ষীরা মুক্তাঞ্চল পরিদর্শন: কর্ণেল এম এ জি ওসমানীর সাতক্ষীরা মুক্তাঞ্চল পরিদর্শনের পর স্বদেশের মাটি সাতক্ষীরার মুক্তাঞ্চল প্রথম পরিদর্শনে আসেন ১৯৭১ এর প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী (জাতীয় নেতা) এম কামরুজ্জামান। এসময় তাঁর সাথে ছিলেন দেশী-বিদেশী গণমাধ্যম কর্মী ও রাজনৈতিক নেত্রীবৃন্দ। দলে দলে মুক্তির আনন্দে উদ্বেলিত উৎসুক জনতা তাঁদের অর্ভথ্যনা জানায়।
ভারতীয় মিত্র সেনাবাহিনী বাংলাদেশে ঢোকার পূর্বেই মুক্তিযোদ্ধাগণের প্রতাপী পরাক্রমের মুখে সাতক্ষীরা শহর পাকহানাদার মুক্ত হওয়ার বিষয়টি নিঃসন্দেহে মুক্তিযুদ্ধের একটি ব্যাতিক্রমি মূল্যায়নের অধ্যায়। ৩ থেকে ৬ ডিসেম্বর একটি ধারাবাহিক সুসমন্বয়ি মিশনে সাতক্ষীরা শহরসহ এর অন্যান্য বৃহৎ অঞ্চল প্রথম সম্পূর্ণভাবে পাকহানাদার আগ্রসনমুক্ত হয়। ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা থ্রিনটথ্রি আর এসএলআরের ফাঁকা গুলি ছুড়তে ছুড়তে সাতক্ষীরা শহরে প্রবেশ করে। ওড়ানো হয় স্বাধীন বাংলার লাল-সবুজের পতাকা। মুক্ত অঞ্চলের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি বা ঘোষণার নিদর্শন সৃষ্টি করা হয়। সন্তান হারানোর বেদনা ভুলে সেদিন মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে রাস্তায় নেমে বিজয় উল্লাসে মেতে ওঠেন মুক্তিপাগল আমজনতা। জয়ের সে উন্মাদনায় উদ্বেলিত হয়ে ওঠে সাতক্ষীরার দামাল ছেলেমেয়েরাও। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের এই সাফল্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধা জনতার মনে পূর্ণ স্বাধীনতার স্বপ্ন জাগায়। সাতক্ষীরা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার মোশারাফ হোসেন মশু জানান, ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর হানাদারবাহীনির হাত থেকে সাতক্ষীরাকে মুক্ত করা হয়। তারপর এক পর্যায়ে ৭ ডিসেম্বরের সেই ঐতিহাসিক দিনটিতে নিয়মিতভাবে সাতক্ষীরা মুক্ত দিবস পালিত হওয়ার রেওয়াজ প্রচরিত হয়।
বহু রক্ত ও প্রাণের উৎসর্গের মাধ্যমে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের শেষ জেলা সাতক্ষীরা হানাদার মুক্ত হলেও এখনও পর্যন্ত পাকিস্তানি হানাদারদের বাঙালি দোসর বা অনুসারীরা নিঃশেষ হয়ে যায়নি। তাই স্বাধিনতা পেলেও আমরা তাদের উত্তরসূরীরদের সহঅবস্থানে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও বাদ-প্রতিবাদ থেকে পুরোপুরি পরিত্রান পায়নি। তাই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও সাতক্ষীরা মুক্ত দিবসের তাৎপর্য নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে, তাহলে নতুন প্রজন্ম মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ আর অর্জন-বিসর্জনের অনুপ্রেরণায় নিজেদেরকে গড়ে তুলতে পারবে। দেশ স্বাধীনের ৫২ বছর পেরিয়ে গেলেও সাতক্ষীরার বর্ধ্যভূমি ও বর্ধ্যভূমি-স্মৃতিসৌধগুলি রয়ে গেছে অবহেলিত, অসংরক্ষিত। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বীর সেনানী ও সাধারণ জনগোষ্ঠীদের আজীবন স্মরণীয় করে রাখতে ওই সব বর্ধ্যভূমি ও স্মৃতিসৌধগুলি সংস্ককারে পাশাপাশি অবশিষ্ঠ স্মৃতিসৌধগুলো দ্রুত নির্মাণের দাবি স্থানীয়দের। ইতিমধ্যে এ জনদাবির স¦পক্ষে স্থানীয় ‘৭১ এর বর্ধ্যভূমি স্মৃতি সংরক্ষণ কমিটি’ জোর তৎপরতা চলাচ্ছে। যার আহবায়ক: বীর মুক্তিযোদ্ধা সুভাষ সরকার জানান-‘তালা ও কলারোয়াসহ বিভিন্ন উপজেলায় সরকারি উদ্যোগে বর্ধ্যভূমি ও গণকবরগুলো চিহ্নিত করে বর্ধ্যভূমির স্মৃতিসৌধ বানানো হয়েছে। সেগুলির উপযুক্ত সংস্কারর ও সংরক্ষনের পাশাপাশি জেলা সদর ও উপজেলার আরও কয়েকটি পয়েন্টে স্মৃতিসৌধ ও তৎসংলগ্ন কমপ্লেক্স নির্মাণের প্রক্রিয়া চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।’
বর্তমানে সাতক্ষীরা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কোন কমিটি নেই। সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মহোদয়কে এক সদস্য বিশিষ্টি কমিটির কমান্ডার করা হয়েছিলো। যিনি কোন মুক্তিযোদ্ধা নন বা মুক্তিযুদ্ধের সময় হয়তো তাঁর জন্মও হয়নি। এটি আমাদের জন্য একটা ব্যার্থতা। আর কমিটি বিলুপ্তি ও পুনঃগঠনের চলমান নিয়মিত প্রক্রিয়ায় বিপর্যয় ঘটার নেপথ্য ঘটনা আরও ব্যার্থতার, লজ্জার ও কলঙ্কের। জনসমর্থন, জনসম্পৃক্ততা ও গণতন্ত্র চর্চা বা প্রতিষ্ঠার চিরচারিত সংস্কৃতি এবং দর্শন থেকে বিছিন্ন হয়ে ক্ষমতাধরদের ব্যক্তিস্বার্থের অভ্যন্তরিন আন্তঃদ্বন্দ্ব সকল সেক্টরকে এভাবে বিপদগ্রস্থ করে তুলেছে। এমনটি চলতে থাকলে স্থানীয় পর্যায়ে সর্বস্তরে আমাদের স্বাধিনতার সুফল ভোগে আরও অপেক্ষা করতে হবে।