লিখছি আপনার কাছে, কারণ আপনি বলেছিলেন। হয়তো মনে নেই আপনার, কিন্তু আমদেরতো অনেক কথাই বাকি। এবার উত্তর দিন, নাকি চুপ থাকবেন? মনে রাখবেন, ভালোবাসাবঞ্চিরা আপনাকেই ভালবেসেছিল।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের গল্প আমি জানি। সেই রক্তের পথ বেয়ে উঠে আসা প্রতিশ্রুতি ভরা স্বপ্নের কথা জানি। কিন্তু আজ যখন রাত গভীর হয়, আর দেশজুড়ে হতাশার নীরবতা ভেঙে চিৎকার শোনা যায়, তখন মনে প্রশ্ন জাগে—এই স্বপ্নগুলো কি হারিয়ে গেছে?
আজ রাস্তায় যারা নিজেদের নিরাপত্তার জন্য আকুতি জানাচ্ছে, তাদের কান্না কি শুনছেন? যারা বুকের রক্ত দিয়ে পরিবর্তনের আশা তৈরি করেছিল, তাদের প্রতি আপনার দায়বদ্ধতা কি ফুরিয়ে গেছে? কেন এই অনিরাপত্তা, কেন এই বৈষম্য?
আপনি বলেছিলেন, মন খুলে সমালোচনা করতে। এই চিঠি সেই সমালোচনার শব্দ। এটি সেই গল্পের কথা বলছে, যে গল্পে মানুষ তার আস্থা হারিয়েছে। কারণ, আপনার প্রতিশ্রুতির জায়গা দখল করেছে অসহায়তার দীর্ঘশ্বাস।
ইজতেমার মাঠে তিনটি প্রাণ হারানো কি কেবলই একটি সংখ্যা? না, এটি আরও গভীর সংকেত দেয়—একটি শৃঙ্খলাহীন সমাজের। যেখানে চাঁদাবাজি দমনের কথা থাকলেও, তা রক্তাক্ত বিকেলে লেপ্টে যায়।
জুলাই গণহত্যার বিচার আজও অনিশ্চিত। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে মানুষ দিশেহারা, সিন্ডিকেটের কবলে অসহায়। আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে—যে যাকে পারছে মারছে, বলপ্রয়োগ করছে। গুপ্তহত্যার আতঙ্কে মানুষ ঘুমাতে পারে না। এই ভয়াবহ অরাজকতার দায় এড়াবেন কীভাবে? আপনারা কি তবে ব্যর্থ নন?
আমাদের ধারণা জন্মেছে আপনি এবং আপনার উপদেষ্টাদের প্রায় সকলেই জুলাই অভ্যুত্থানকে ধারণ করেন না। আপনাদের ইতিহাসের সেই রক্তাক্ত অধ্যায়ের কোনো অংশীদারিত্ব নেই। তাই হয়তো বোঝেন না যে, এক সুমুদ্র রক্তের বিনিময়ে পতন হয়েছিল আওয়ামী ফ্যাসিবাদী শাসনের। প্রাণ দিয়েছিল প্রায় দুই হাজার ছাত্র ও জনতা—তাদের স্বপ্ন ছিল একটি নিরাপদ ও ন্যায়বিচারপূর্ণ সমাজ। কিন্তু সেই স্বপ্ন আজ হতাশার ধূলায় ঢাকা। আপনার তখন ছিলেন না, তাই হয়তো এই বিপ্লবের দায় ও সংগ্রামের মর্ম উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হচ্ছেন।
আমরা জুলাই বিপ্লবের অংশ ছিলাম, এই সরকারের নয়। তাই যখন কেউ বলে, "কিসের জন্য করলেন? আগেই ভালো ছিলাম," তখন নিজের অবস্থান বুঝাতে গিয়ে অসহায় লাগে। বিপ্লবের স্বপ্ন ছিল ন্যায়বিচার ও নিরাপত্তা, কিন্তু আজ দেশজুড়ে অরাজকতা আর হতাশা। আমার এই অসহায়ত্বের দায় কি তবে আপনাদের নয়?
আপনার শান্তি পুরস্কারের কথা আমরা শুনেছি। কিন্তু গত কয়েক মাসে এই দেশের জনগণ সেই শান্তির একটুও ছায়া পায়নি। ক্ষমতার কেন্দ্রে বসে কি এই বাস্তবতা উপলব্ধি করেন? নাকি ক্ষমতার আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখেই তৃপ্ত?
এই যে আজ মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, এর উত্তর কে দেবে? যে শিক্ষার্থীরা রাত জাগছে নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত হয়ে, তাদের স্বপ্নভঙ্গের দায় কি আপনি নেবেন?
আপনি হয়তো বলবেন, এই সময় কেটে যাবে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, যে সময়ের দাবিকে উপেক্ষা করা হয়, সে সময় একদিন প্রতিবাদ হয়ে দাঁড়ায়। আর সেই প্রতিবাদ হয়ে ওঠে আরও শক্তিশালী।
আমরা গল্প বলি, কষ্টের গল্প। আমরা স্বপ্ন দেখি, একটি ন্যায্য সমাজের। যেখানে কেউ রক্তপাত ঘটাতে পারবে না।
তাই বলছি, এই নীরবতা ভাঙুন। মানুষের কাছে আসুন। তাদের কথা শুনুন। শাসক নয়, একজন প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব নিন। কারণ, সময়ের দরজা কখনো চিরকাল খোলা থাকে না।
মো: তানজিম হোসাইন,
শিক্ষক ও সাংবাদিক