মাসুদ রায়হান যশোর জেলা প্রতিনিধিঃ।
প্রখ্যাত ইসলামি স্কলার ড. মিজানুর রহমান আজহারীর মাহফিলে গিয়ে পদদলিত হয়েছে অন্তত ৩০ জন আহত হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
শুক্রবার রাতে শহরতলি পুলেরহাটের আদ-দ্বীন সকিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল চত্বর ও আশপাশ এলাকায় তারা পদদলিত হন। আহতদের যশোর জেনারেল হাসপাতালসহ স্থানীয় বিভিন্ন ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়েছে।
শুক্রবার রাত ১০টা পর্যন্ত যশোর জেনারেল হাসপাতালে ১০ জন্ ভর্তি হওয়ার তথ্য নিশ্চিত করেছেন হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার বজলুর রশিদ।
প্রত্যক্ষদর্শী ও আহতরা জানান, শুক্রবার রাতে মাহফিলস্থলের প্রধান ফটকের সামনে যশোর-বেনাপোল মহাসড়কে অতিরিক্ত মানুষের সমাগমে বন্ধ হয়ে যায় চলাচল। এসময় সড়কের উপরে মানুষের ভেতরে আগে যাওয়া-আসাকে কেন্দ্র করে হট্টগোল শুরু হলে ধাক্কাধাক্কিতে অনেকেই পড়ে যান। এতে পদদলিত হয়ে অনেকেই আহত হন। এসময় আহতদের স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় উদ্ধার করে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
জানা যায়, তাফসিরুল কোরআন মাহফিলকে ঘিরে শুক্রবার (৩ জানুয়ারি) যশোর শহরে মানুষের ঢল নামে। এদিন সকাল থেকেই চারপাশ থেকে মানুষ স্রোতের মতো আসতে থাকে যশোর শহরতলীর পুলেরহাটে মাহফিলস্থলে।
দুপুরের মধ্যেই ময়দান কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। বন্ধ করে দেওয়া হয় প্রবেশের জন্যে তৈরি চারটি গেট। মুসল্লিরা অবস্থান নেন আশপাশের এলাকাগুলোতে।
সন্ধ্যা পার হয়ে গেলেও মানুষের স্রোত থামেনি। বরং আরও বাড়তে থাকে। যার প্রভাবে জেলা শহরের দক্ষিণাঞ্চলের পুরো অংশ মানুষের মেলায় পরিণত হয়। পাড়া-মহল্লাগুলোতে সাদা কাপড় টাঙিয়ে সরাসরি সম্প্রচার করতে দেখা যায়। আয়োজকদের ধারণা ১৫ লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতি ঘটেছে এই মাহফিলে। মানুষের ভিড়ে মাহফিলে ধাক্কাধাক্কিতে ৩০ জনের আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। যাদের মধ্যে দশজনকে যশোর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। অন্যান্যদেরকে শহরের এবং শহরতলীর বিভিন্ন বেসরকারি প্রাইভেট ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়েছে।
চিকিৎসকরা জানান, অধিকাংশের বুক এবং শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত লেগেছে।
আহতদের স্বজনেরা বলেন, আজ (শুক্রবার ৩জানুয়ারি) রাতে তাঁরা পুলেটহাটে মিজানুর রহমান আজহারীর ওয়াজ মাহফিলে যাচ্ছিলেন। মাহফিল স্থলের প্রধান ফটকের সামনে যশোর–বেনাপোল মহাসড়কে অতিরিক্ত মানুষের সমাগমে চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় সড়কে আগে যাওয়া-আসাকে কেন্দ্র করে হট্টগোল শুরু হলে ধাক্কাধাক্কিতে অনেকে পড়ে যান। এতে পদদলিত হয়ে তাঁরা আহত হন। এ সময় স্থানীয়রা উদ্ধার করে তাঁদের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করে। এর মধ্যে গুরুতর আহত অবস্থায় ১০জন যশোর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
এদিকে ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও মাহফিলে দায়িত্বরত স্বেচ্ছাসেবীরা জানায়, অন্তত ৩০ জন আহতের ঘটনা ঘটেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একাধিক মৃত্যুর খবরও রটেছে। যদিও এ বিষয়ে যশোর কোতোয়ালি মডেল থানার পুলিশ বা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারেনি।
এ বিষয়ে যশোর জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার বজলুর রশিদ বলেন, যশোর জেনারেল হাসপাতালে দশজন ভর্তি হয়েছে।
এদিকে আদ্-দ্বীন ফাউন্ডেশন আয়োজিত তিন দিনব্যাপী তাফসিরুল কোরআন মাহফিলের শেষ দিনে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের ঢল নামে। আজহারির আসার খবরে মাহফিল প্রাঙ্গণে ১৫ লক্ষাধিক মানুষের সমাগম ঘটে। সকাল থেকে শীত উপেক্ষা করে মানুষের জমায়েত হয়। বিকেল থেকে মাহফিলের স্থান ছাপিয়ে সড়ক, মহাসড়কেও শিশু, নারী, পুরুষের ঢল নামে। দুপুরের পর সড়কে যানজট দেখা দেয়। এ জন্য অনেকে হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছায়। সব সড়কের ঢেউ গিয়ে মেশে পুলেরহাটে। সন্ধ্যায় আস সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শায়খ আহমাদুল্লাহও বক্তব্য দেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, শুক্রবার সকাল থেকেই যশোর-বেনাপোল, যশোর-ঝিনাইদহ, যশোর-মাগুরা, যশোর-খুলনা মহাসড়কসহ বিভিন্ন সড়ক ধরে লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসল্লি শহরতলির পুলেরহাটের অভিমুখে রওনা হয়েছে। দুপুরের পর সড়ক ও মহাসড়কগুলোতে যানবাহনের চাপ বাড়ে। বাসের পাশাপাশি ট্রাক, মাইক্রো, ইজিবাইক, মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন যানবাহনে চড়ে মানুষ গন্তব্যে রওনা হন। এ ছাড়া ট্রেনে চড়েও অনেকে যশোর স্টেশনে নামেন। সেখান থেকে হেঁটে, যানবাহনে চড়ে অনেকে গন্তব্যে যান। গোটা শহরতলিতে মানুষের উপচেপড়া ভিড় লক্ষ্য করা যায়। সন্ধ্যার পর পায়ে হাঁটা মানুষের সংখ্যা বেড়ে যায়। অনেকেই মূল অনুষ্ঠানে স্থলে পৌঁছাতে পারেনি। দূর থেকেই বক্তব্য শুনতে হয়েছে।
শহরের রেলগেট এলাকায় যানজটে দাঁড়িয়ে থাকা ইজিবাইকের যাত্রী সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘আজহারী সাহেব আসছেন শুনে এসেছি। মাহফিলে যাচ্ছি। কিন্তু পথে প্রচণ্ড জ্যামের কারণে আটকে আছি। খুব ধীরে যাচ্ছে যানবাহন। রোডে প্রচুর মানুষের ভিড়।’
লিমন হোসেন নামে এক রিকশা চালক বলেন, ‘চাঁচড়া পুলেরহাটের দিকে রিকশা নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে না। অনেক লোকের ভিড়। দুপুরের পর থেকে রিকশা নিয়ে ডালমিল পার হতে পারিনি। এখন যাত্রীরা সব হেঁটে যাচ্ছে। রেলগেট পার হলেই আর সামনে আগানো যাচ্ছে না।’
শহর ও শহরতলির প্রায় প্রতিটি সড়ক-মহাসড়কের চিত্র একই। শহরের চাঁচড়া মোড় থেকে পুলেরহাট অভিমুখে সবচেয়ে বেশি মানুষের ঢল নামে। এসব সড়কের মানুষের ভোগান্তিও ছিল চোখে পড়ার মতো।
এদিকে মাহফিল উপলক্ষে চার দিনব্যাপী ইসলামী বই মেলা ও প্রদর্শনী করা হয়েছে। মেলায় ২২টি স্টল রয়েছে। একই সঙ্গে শিশুদের জন্য ‘কিডস জোন’ করা হয়েছে।
আদ্-দ্বীন ফাউন্ডেশনের মানব সম্পদ কর্মকর্তা জাহেদ হোসাইন বলেন, আদ্-দ্বীন ফাউন্ডেশন শুধু ওয়াজ মাহফিলের মধ্যে সীমাবদ্ধ করেনি। এখানে ইসলামী কৃষ্টি কালচার তুলে ধরা হচ্ছে।
দেশের ছয়জন স্কলারদের উপস্থিতিতে পুলেরহাটে তিনদিনব্যাপী তাফসিরুল কোরআন মাহফিল শুরু হয় গত বুধবার (১ জানুয়ারি)। আদ্-দ্বীন ফাউন্ডেশন এই মাহফিলের আয়োজন করে। প্রথম দুদিন আলোচনা করেন আব্দুল হাই মুহাম্মদ সাইফুল্লাহ, আল্লামা মামুনুল হক, মাওলানা রফিকুল ইসলাম মাদানী ও মুফতি আমির হামজা।
শুক্রবার প্রথমে আলোচনা করেন শায়খ আহমাদুল্লাহ। শেষ বক্তা ড. মিজানুর রহমান আজহারী আলোচনা শুরু করেন রাত ৯টার দিকে। মূলত ড. আজহারীর আলোচনা শোনার জন্যেই মানুষের মধ্যে এত আগ্রহ দেখা গেছে।
প্রথম দুদিন মাহফিলে মুসল্লিদের স্বাভাবিক উপস্থিতি থাকলেও শুক্রবার সকাল থেকেই মানুষের যেন স্রোত নামে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যশোরের বিভিন্ন উপজেলা ছাড়াও মাহফিলে উপস্থিত হয়েছেন ঝিনাইদহ, মাগুরা, নড়াইল, সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, বাগেরহাট, খুলনা, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, পিরোজপুরের মানুষ।
প্রতিটি স্থান থেকেই পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও মাহফিল শুনতে আসেন।
যশোরের সাধারণ মানুষরা বলেছেন, কোনো আয়োজনে এত মানুষের উপস্থিতি অতীতে আর কখনও দেখা যায়নি এই জেলায়। আয়োজকদের ধারণা মাহফিল শুনতে ১৫ লাখের বেশি মানুষের উপস্থিতি ঘটেছে। তবে, জেলাবাসীর ধারণা এই সংখ্যা আরও বেশি।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সন্ধ্যা ৭টার দিকে মাহফিল চত্বরে প্রবেশদ্বারে হঠাৎ ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়। এতে ৩০ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে দশজনকে যশোর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
হাসপাতালে ভর্তিদের মধ্যে নয়জনের নাম জানা গেছে। তারা হলেন- মইনুল ইসলাম (৩২), ওসমান গণী (১৮), জিয়ান (২১), মারজান (১৮), ইব্রাহীম (৪০), মাসুদ (২৬), সাইদুল (২৮), লাবলী (৩০) ও আফিফা (১৪)।
আহতরা জানান, তারা শুক্রবার সকালে পুলেটহাটে মিজানুর রহমান আজহারীর ওয়াজে এসেছিলেন। মেইন গেট তালাবদ্ধ থাকায় তারা সবাই গেটের বাইরে অপেক্ষা করছিলেন। হঠাৎ সেখানে ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়। এক পর্যায়ে পেছনে দাঁড়িয়ে থাকারা সামনে এগোতে চেষ্টা করলে হট্টগোল শুরু হয়। এ সময় পেছন থেকে ধাক্কায় সামনে দাঁড়িয়ে থাকারা মাটিতে পড়ে পদদলিত হন। পরে স্থানীয়রা গুরুতর আহতদের উদ্ধার করে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করেন।
যশোর জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ডাক্তার জুবাইদা ইসলাম বলেন, আহতরা সবাই পদদলিত হয়ে আহত হয়েছেন। আহতদের মহিলা ও পুরুষ সার্জারি ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়েছে। এদের মধ্যে আফিফা নামে একজনের অবস্থা গুরুতর। অন্যরা আশঙ্কামুক্ত।