বিদ্যালয়ের গেট পার হতেই একজোড়া শ্রদ্ধাভরা চোখ, একগুচ্ছ কচি হাতের সালাম, আর একরাশ স্বপ্নের আলোকছটা ঘিরে ধরে একজন শিক্ষককে। সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ গড়ে ওঠে শিক্ষকের হাত ধরে, কিন্তু তার নিজস্ব গল্প? তার সংগ্রাম?
দেশের এক প্রান্তে কোনো এক এমপিওভুক্ত শিক্ষক হয়তো চেয়ারে বসে হিসাব মেলাচ্ছেন—এই মাসের বেতন দিয়ে ছেলের স্কুলের বেতন দেবেন, নাকি অসুস্থ মায়ের ওষুধ কিনবেন? অথচ তিনি প্রতিদিন ক্লাসে গিয়ে শেখান, “শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড।”
কিন্তু এই মেরুদণ্ড যারা গড়ে দেন, তাদেরই মেরুদণ্ড কতটা সোজা? তাদের জীবন চলে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে, আর মান-মর্যাদার স্বপ্ন শুধু কাগজে-কলমে।
শিক্ষক মানেই গুরু, শিক্ষক মানেই শ্রদ্ধার মানুষ। কিন্তু বাস্তবতায়?
যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি পরীক্ষার খাতায় নম্বর দিচ্ছেন, ক্লাসে পড়াচ্ছেন, ততক্ষণ তিনি মূল্যবান। কিন্তু যখন বেতন বাড়ানোর দাবি তোলেন, ন্যায্য অধিকার চান, তখনই তিনি ‘লোভী’, ‘অতিরিক্ত সুবিধা চাইছে’—এই তকমা গায়ে সেঁটে দেওয়া হয়।
একজন শিক্ষক যখন ক্লাসে যান, তখন তার ব্যক্তিগত জীবন পেছনে ফেলে যান। কিন্তু সেই শিক্ষকের সন্তান হয়তো পড়ার উপযুক্ত পরিবেশ পাননা, সংসারে অভাব তাড়া করে বেড়ায়, চিকিৎসার অভাবে অকালে চলে যান অনেকেই। এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা বছরের পর বছর কাজ করে যান অর্ধেক স্বপ্ন নিয়ে, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করেন পূর্ণ মর্যাদার জন্য।
যে শিক্ষক তার ছাত্রকে নৈতিকতা শেখান, তার নিজের জীবনে কত অনৈতিক অবহেলা!
যে শিক্ষক বিজ্ঞান পড়ান, তার নিজের জীবন চলে অবৈজ্ঞানিক টিকে থাকার লড়াইয়ে!
যে শিক্ষক অর্থনীতির পাঠ দেন, তার নিজের সংসারে অর্থনীতির সমীকরণ কখনো মেলে না!
তবু তিনি হাসেন, তবু তিনি পড়ান। কারণ তার বুকের ভেতর জমে থাকা ভালোবাসার পাহাড়ের নাম ‘শিক্ষার্থী’। কিন্তু সেই শিক্ষার্থীরাই একদিন বড় হয়ে যখন বলে—“স্যার, আপনারা তো কিছুই করতে পারেন না!”—তখন তার বুক ফেটে যায়।
শিক্ষক শুধু একজন পেশাজীবী নন, তিনি ভবিষ্যৎ গড়ার কারিগর। অথচ তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে অবহেলা, বঞ্চনা আর অসম্মানের ইতিহাস জুড়ে থাকে। এই বাস্তবতা বদলাবে কবে?
জাতি কি পারবে এই যোদ্ধাদের প্রকৃত সম্মান দিতে? নাকি তারা আজীবন নিঃশব্দেই নিঃশেষ হয়ে যাবেন?
একজন শিক্ষক শুধু শিক্ষা দেন না, তিনি জীবন গড়েন—কিন্তু আফসোস, তার নিজের জীবনটা গড়ার সুযোগ কেউ দেয় না! (মতামত)
মো: তানজিম হোসাইন
শিক্ষক ও সাংবাদিক