উজ্জ্বল কুমার সরকার
নওগাঁ জেলা প্রতিনিধিঃ
নওগাঁর মহাদেবপুরে নওগাঁ-৩ (মহাদেবপুর-বদলগাছী) আসনের সাবেক এমপি ছলিম উদ্দিন তরফদার সেলিমের ছেলে সাকলাইন মাহমুদ রকির বাড়িতে কথিত পাওনাদারেরা হানা দিয়েছেন। এনিয়ে এলাকায় তোলপাড় শুরু হয়েছে। সোমবার (২৮ অক্টোবর) দুপুর আড়াইটায় উপজেলা সদরের হাইস্কুল মোড়ে অবস্থিত পাঁচতলা নক্ষত্র বাড়ি নামক ওই বাড়িতে গিয়ে তারা প্রায় তিন ঘন্টা অবস্থান করেন। কিন্তু এমপির ছেলে বলছেন তারা কোন টাকা পাবেন না। প্রকৃতপক্ষেই তারা কি টাকা পাবেন, নাকি পটপরিবর্তনের সুযোগ নিচ্ছেন তা নিয়ে স্থানীয় জনমনে চলছে আলোচনা সমালোচনা, নানান গুঞ্জন। স্থানীয়রা জানান, দুপুরে ২০/২৫ জনের একটি দল নক্ষত্র বাড়িতে গিয়ে সাবেক এমপির ছেলে সাকলাইন মাহমুদ রকি ও তার ছোট ভাইয়ের খোঁজ করেন। ছোট ভাইকে পেলেও রকির দেখা তারা পাননি। তারা তার ছোট ভাইয়ের সাথে কথা বলে রকির খোঁজ করতে থাকেন। পরে তারা চলে যান। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন এক সময়ের এমপি ছলিম উদ্দিন তরফদারের বিশ্বস্ত খাদেম বলে পরিচিত চিহ্নিত বালু ব্যবসায়ী ও উপজেলা আওয়ামী লীগের অর্থ সম্পাদক হাজী মোয়াজ্জেম হোসেন এবং সাবেক বিএনপি নেতা হাজী আক্কাস আলী। সাবেক এমপির ছেলের বাড়িতে একসাথে অনেক মানুষের ভীড় দেখে স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়। এখবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে বিষয়টি ট্যক অব দ্য টাউনে পরিণত হয়। স্থানীয়রা জানান, নক্ষত্র বাড়ি নামে এই বাড়িটি একসময় জমজমাট ছিল। মহাদেবপুর ও বদলগাছী উপজেলার সব বিষয়ের কেন্দ্রবিন্দু ছিল এটি। দিন রাত লোকে লোকারণ্য থাকতো বাড়িটি। নওগাঁ-৩ আসনে ছলিম উদ্দিন তরফদার ২০১৪ সালে কলস প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তখনকার নৌকার প্রার্থী আগেরবারের এমপি ড. আকরাম হোসেন চৌধুরীকে পরাজিত করে বিজয়ী হন। ২০১৮ সালে তিনি নৌকা প্রতীক পান এবং আবার এমপি নির্বাচিত হন। কিন্তু ২০২৪ সালে তাকে নৌকা না দিয়ে দেয়া হয় সাবেক সচিব সৌরেন্দ্রনাথ চক্রবর্ত্তী সৌরেনকে। সেবার ছলিম উদ্দিন তরফদার ট্রাক প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন। এরপর থেকেই এই বাড়িটি জৌলুস হারাতে শুরু করে। ৫ আগস্টের পর এই বাড়ি একপ্রকার মানবশুন্য হয়ে পড়ে। তাই সোমবারের অনেক মানুষের ভীড় দেখে স্থানীয়রা ভড়কে যান। জানতে চাইলে উপজেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাজী আক্কাস আলী ওই বাড়িতে যাবার কথা স্বীকার করে জানান, তিনি আছরের নামাজের পর সেখানে গিয়েছিলেন। তার আগেই দুপুরে অন্যরা সেখানে গিয়ে অবস্থান করছিলেন। হাজী আক্কাস সাবেক এমপির ছেলে সাকলাইন মাহমুদ রকিকে না পেয়ে ফিরে আসেন বলে জানান। তিনি জানান, সাবেক এমপি ছলিম উদ্দিন তরফদারের কাছ থেকে তিনি ২৪ লক্ষ টাকা পাওনাদার রয়েছেন। টাকাগুলো আদায় করার জন্যই তিনি নক্ষত্র বাড়িতে গিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে বিভিন্ন সময় এই টাকাগুলো এমপি ছলিম উদ্দিন তরফদার সেলিম ও তার ছেলে রকি তার কাছ থেকে বিভিন্নভাবে চাঁদাবাজি করে নিয়েছেন বলেও জানান হাজী আক্কাস। তিনি জানান, তিনি উপজেলা সদরের আখেড়া এলাকায় একটি পুকুর খননের সময় এমপি ছলিম উদ্দিন ও তার ছেলে রকি দুই লক্ষ ৭০ হাজার টাকা, পটুয়াখালীর ঠিকাদারের কাছ থেকে সাব লিজ নিয়ে আত্রাই নদীর বাঁধে মাটি দেয়ার সময় দুই বারে পাঁচ লক্ষ করে ১০ লক্ষ টাকা, সেখানে আবার তার মাটির গাড়ী আটকে রেখে ১০ লক্ষ টাকা এভাবে তার কাছ থেকে মোট ২৪ লক্ষ টাকা চাঁদা নিয়েছেন। এখন সে টাকা তিনি ফেরৎ নেয়ার জন্য তাদেরকে খুঁজছেন। তবে এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত তিনি কোথাও কোন মামলা দায়ের করেননি। উল্লেখ্য, ১৯৯১ সালে নওগাঁ-৩ আসনে বিএনপির প্রার্থী আখতার হামিদ সিদ্দিকী নান্নু এমপি নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলেও আখতার হামিদ সিদ্দিকী আবার এমপি নির্বাচিত হন। ২০০১ সালেও তিনি এমপি নির্বাচিত হন। এ সময় বিএনপি সরকার গঠন করলে তিনি জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পীকার নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সাল থেকেই তদানিন্তন উপজেলা যুবদলের কোষাধ্যক্ষ আক্কাস আলী এমপি আখতার হামিদ সিদ্দিকীর অঘোষিত বডি গার্ড হিসেবে তার সাথে থাকেন। ২০০১ সালের পর আক্কাস আলী বিভিন্ন ব্যবসায় জড়িয়ে বিস্তর টাকার মালিক হন। ডেপুটি স্পীকারের পরেই এলাকার প্রায় সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। দীর্ঘদিন বিএনপি ক্ষমতায় না থাকলেও হাজী আক্কাস অত্যন্ত দাপটের সাথে তার ব্যবসায় চালিয়ে যান। আওয়ামী লীগ নেতাদের বিভিন্নভাবে ম্যানেজ করেই চলতো তার ব্যবসায়। আওয়ামী লীগের পতনের পর এখন তিনি তার সেসব ম্যানেজ করার জন্য দেয়া টাকা ফেরৎ চাচ্ছেন। জানতে চাইলে এক সময়ের এমপি ছলিম উদ্দিন তরফদার সেলিমের দক্ষিণ হস্ত হাজী মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, তিনি সাবেক এই এমপির কাছ থেকে এক কোটি ৯১ লক্ষ টাকা পাওনাদার। ৫ আগস্টের পর তারা সবাই পলাতক ছিলেন। তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা নাশকতা মামলায় সম্প্রতি কোর্ট থেকে জামিন নিয়ে এখন নিজ নিজ বাড়িতেই অবস্থান করছেন। এখবর পাবার পর তিনি তার পাওনা আদায়ের জন্য দুপুরে ২০/২৫ জন অনুসারীসহ নক্ষত্র বাড়িতে গিয়েছিলেন। খোঁজাখুজি করে বাবু নামে একজন ম্যানেজার ও সাবেক এমপির ছোট ছেলের দেখা পান। তাদেরকে দিয়ে সাবেক এমপিকে ফোন দিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। সাবেক এমপির বড় ভাইকে ফোন দিয়ে টাকা পরিশোধ করতে বলেন। তিনি এ ব্যাপারে বৈঠক করার আশ্বাস দিয়েছেন। তার ধারণা সাবেক এমপির বড় ছেলে সাকলাইন মাহমুদ রকি ওই বাড়ির পাঁচটি তালার যেকোন একটি ঘরে তালা দিয়ে লুকিয়ে আছেন। একারণে কয়েক ঘন্টা ধরে তার খোঁজ করেন।
কি বাবদ তিনি এতগুলো টাকা পাবেন জানতে চাইলে হাজী মোয়াজ্জেম হোসেন ২৭ পৃষ্ঠাব্যাপী একটি হিসাবের ফিরিস্তি দাখিল করেন। এগুলোতে দেখা যায়, মেসার্স হ্যাপি ট্রেডার্সের প্রোপাইটর হাজী মোয়াজ্জেম হোসেন ছলিম উদ্দিন তরফদারের কাছ থেকে এক কোটি ৩৫ লক্ষ ৫৪ হাজার ১৮৩ টাকা পাওনাদার রয়েছেন। এ ছাড়া আরো হিসাব রয়েছে বলেও জানান তিনি। ওই হিসাবের ২০২৩ সালের ১৪ ডিসেম্বরের টপশীটে সংক্ষিপ্তভাবে লেখা রয়েছে একটি জমি বাবদ ভাগ পাঁচ লক্ষ টাকা, এমপির ভাগ্নে ও সদর ইউপি চেয়ারম্যান সাঈদ হাসান তরফদার শাকিলের নামে এনআরবিসি ব্যাংকের কিস্তি চার লক্ষ টাকা, এশিয়া ব্যাংকের কারের মূল্য ২২ লক্ষ ৭০ হাজার ৪০০ টাকা, ইসলামি ব্যাংকের ডিপিএস দুই লক্ষ ৮০ হাজার টাকা, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ডিপিএস ১৮ লক্ষ ২০ হাজার টাকা, গাহলী পুকুরের ময়দা বাবদ ১১ হাজার ৫০০ টাকা, চাঁন্দা ঈদগাঁ বিটে বালু পরিবহণের ভাড়া ৩২ হাজার টাকা, কাঞ্চন-নওগাঁ-নওহাটা-বাসা ট্রাক্টর ভাড়া ১০ হাজার ৫০০ টাকা, চেরাগপুর ইউপি চেয়ারম্যান শ্রী শিবনাথ মিশ্রের বাঁকি ৮৬ হাজার ২০০ টাকা, আলীপুর রাস্তায় বিটবালু পরিবহণের ভাড়া ১০ লক্ষ ৯ হাজার ৫০০ টাকা, চেরাগপুর ইটভাঁটায় মাটি ও বিট দেয়া ৪৯ লক্ষ ৮ হাজার ৫০০ টাকা, সাপাহারে বিটবালু পরিবহণ ৩২ হাজার টাকা, নগদ হাওলাদ ৩০ লক্ষ ৩৫ হাজার টাকা, গার্লস স্কুলে বিটবালু পরিবহণ ৪ লক্ষ টাকা, শিবগঞ্জের পুকুর থেকে মাটি, বিটবালু, ভ্যেকু মেশিন ভাড়া ১৮ লক্ষ ৪০ হাজার ৮৮৩ টাকা, বাগডোব-দেবীপুর-ধনজইল রাস্তায় বিটবালু পরিবহণ ভাড়া ৬ লক্ষ ২৬ হাজার টাকা, চেরাগপুর ভাটায় বিটবালু পরিবহণ দুই লক্ষ ২৫ হাজার টাকা এবং দলীয় খরচ ১৩ লক্ষ ৬৫ হাজার ৭০০ টাকা। মোট এক কোটি ৩৫ লক্ষ ৪৫ হাজার ১৮৩ টাকা। প্রতিটি হিসাবের ভিন্ন ভিন্ন রশিদও তিনি দাখিল করেন। দলীয় খরচের মধ্যে রয়েছে ২০২২ সালের ১৫ মার্চ আওয়ামী লীগের সম্মেলন বাবদ পাঁচ লক্ষ টাকা, ৩০ মে ছাত্রলীগ নেতা জাহিদ ডেকোরেটর স্বেচ্ছাসেবক লীগের অনুষ্ঠান ৫০ হাজার টাকা ও আবার ৫০ হাজার টাকা, ৩০ জুন আওয়ামী লীগ নেতা বাবুল চন্দ্র ঘোষ বাবু দা স্বেচ্ছাসেবক লীগের খরচ এক লক্ষ টাকা, আওয়ামী লীগের অনুষ্ঠানে ডেকোরেটর ১৪ হাজার টাকা, ৫ জুলাই উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তনু কুমার দেবের ব্যানার বাবদ ৪০ হাজার টাকা, সাঈদ হাসান তরফদার শাকিলের ব্যানার বাবদ ৮০ হাজার টাকা, আওয়ামী লীগের অনুষ্ঠান বাবদ খরচ দুই লক্ষ চার হাজার টাকা, ৭ জুলাই রিক্সাভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নে খাওয়া বাবদ ১৫ হাজার টাকা, ১৯ জুলাই উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আবু মুসা আল আশআরি ও সাধারণ সম্পাদক তনুর জামিন বাবদ ১০ হাজার টাকা, ১৪ আগস্ট শাকিলের ব্যানার বাবদ ২০ হাজার টাকা, ১৫ আগস্ট সাকলাইন মাহমুদ রকি বাবদ ৫০ হাজার টাকা, ১৮ আগস্ট আবু মুছা আলআশআরিকে ছাত্রলীগের অনুষ্ঠান বাবদ তিন হাজার টাকা, ২০ আগস্ট আবার দুই হাজার টাকা, ২৯ আগস্ট পার্টি অফিসে মোটা বালু ও বিট ৯৬ হাজার ৭০০ টাকা, ৯ সেপ্টেম্বর জাহাঙ্গীরপুর কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আহসান হাবীবকে বদলগাছী ছাত্রলীগের অনুষ্ঠান বাবদ ১৫ হাজার টাকা, বাবু ঘোষকে ১৫ আগষ্টের অনুষ্ঠান বাবদ ৫৮ হাজার টাকা, মাতৃপূঁজার অনুষ্ঠান বাবদ সাবেক এমপিকে ৩০ হাজার টাকা, ২০ নভেম্বর আওয়ামী লীগের অনুষ্ঠানে ডিম বাবদ নয় হাজার টাকা, ৫ ডিসেম্বর ছাত্রলীগের সম্পাদক তনুকে ১৫ হাজার টাকা এবং ১৩ ডিসেম্বর ছাত্রলীগ নেতা সোহাগকে চার হাজার টাকা। মোট ১৩ লক্ষ ৬৫ হাজার ৭০০ টাকা।
মোবাইলফোনে সাবেক এমপির ছেলে সাকলাইন মাহমুদ রকি জানান, এরা দুজনের কেউই তাদের কাছ থেকে কোন টাকা পাবেন না। তারা নক্ষত্র বাড়িতে আসার পর রকি সেনাবাহিনীর সহায়তা চেয়েছিলেন বলেও জানান। উল্লেখ্য, হাজী মোয়াজ্জেম হোসেন ঢাকার বিক্রমপুরের বাসিন্দা। তিনি মহাদেবপুর উপজেলা বিএনপির প্রয়াত তদানিন্তন সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান হাতেম আলীর জামাই হিসেবে তার ভোট করেন। কিন্তু ভোটের শেষ দিকে টাকার সংকুলান না হওয়ায় তার ক্যাম্পিং বন্ধ থাকে এবং পুণরায় উপজেলা চেয়ারম্যান পদের ভোটে তিনি পরাজিত হন। হাতেম আলীর মৃত্যুর পর অর্থনৈতিক সংকটে থাকা হাজী মোয়াজ্জেম তদানিন্তন এমপি ছলিম উদ্দিন তরফদারের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলে নানান ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। ক্রমে দলে তার দাপট বাড়তে থাকে। একসময় এমপির ভালো মন্দ সব রকম অর্থনৈতিক কর্মকা- তিনিই পরিচালনা করেন। এ সময় তিনি শত কোটি টাকার মালিক বনে যান। হাসিল করেন উপজেলা আওয়ামী লীগের অর্থ সম্পাদকের পদ। দলীয় নানান অঘটনে জড়িয়ে পড়েন তিনি। ২০২৪ সালে ছলিম উদ্দিন তরফদার নৌকার মনোনয়ন না পেলে হাজী মোয়াজ্জেমও তাকে ছেড়ে চলে যান। এ সময় তিনি নৌকার প্রার্থী সৌরেন্দ্রনাথ চক্রবর্ত্তীর পক্ষে ভোটের প্রচারে অংশ নেন। তখন থেকেই সাবেক এমপির সাথে তার দূরত্ব তৈরি হয়।