আজাদ পাল্প অ্যান্ড পেপার মিলের বর্জ্যে দুষিত বগুড়ার খাল-নদী ও পরিবেশ

 

রাসায়নিক বর্জ্যে বিষাক্ত জলধারা, হুমকিতে কৃষি ও জনস্বাস্থ্য

আজাদুর রহমান, বগুড়া:

বগুড়া জেলার কাহালু উপজেলার বীরকেদার ইউনিয়নের জোগাড়পাড়া এলাকায় অবস্থিত আজাদ পাল্প অ্যান্ড পেপার মিল থেকে নির্গত রাসায়নিক বর্জ্যে তীব্র দূষণের শিকার হচ্ছে আশপাশের খাল, নদী ও কৃষিজমি। মিলের নির্গত সাদা দুধের মতো পানি ও কালো ধোঁয়ায় চারপাশের বাতাস ও পরিবেশ এখন কার্যত বিষাক্ত।

সরেজমিনে দেখা গেছে, কারখানার উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত ব্লিচিং এজেন্ট, সোডিয়াম ক্লোরেট, সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইট, কস্টিক সোডা, অ্যালাম ও ক্যালসিয়াম অক্সাইড মিশ্রিত বর্জ্য পরিশোধন না করেই সরাসরি ফেলা হচ্ছে বগুড়া-নওগাঁ মহাসড়কের পাশের খালে। ওই খালটি হয়ে দূষণ ছড়িয়ে পড়ছে নাগর নদী পর্যন্ত।

আর এই রাসায়নিক পদার্থের কারণে খালের পানিতে তীব্র দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে এবং পানি দুধের মতো সাদা ও আঠালো হয়ে পড়েছে। এতে মাছ, ব্যাঙ, শামুকসহ জলজ প্রাণীর অস্তিত্ব পড়েছে হুমকির মুখে। আশপাশের ফসলি জমিতেও পড়েছে এই বিষের মারাত্মক প্রভাব।

স্থানীয় কৃষক মজনু সাকিদার ক্ষোভ জড়িয়ে বলেন, “আমরা কৃষক মানুষ চাষাবাদ করে খাই। এই মিল এলাকার পাশেই আমার একটুকরো ধানের জমি আছে। আগে বিঘায় ২০ মনের বেশি ধান হতো, এখন ১২-১৩ মনও হয় না। জমিতে নামলে কেমিক্যালের পানির কারণে পা চুলকায়। কিন্তু ওরা প্রভাবশালী মানুষ আমরা কিছু বলি না, মুখ বুজে সহ্য করি”।

একই এলাকার বাসিন্দা শরিফ বলেন “আগে আমরা এই খালে মাছ ধরতাম, শিং, মাগুর, শোল, ছাতান (টাকি) মাছ সহ অনেক প্রকার দেশি ছোট মাছ পাওয়া যেতো, কিন্তু এই মিলের পঁচা পানির জন্য এখন মাছ-তো দুরের কথা ব্যাং, কাঁকড়া, পোকামাকড় সব মরে সাফ হয়ে গেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অন্য এক কৃষক বলেন এই পঁচা পানি বন্ধ না করা গেলে আস্তে আস্তে আমাদের জমি নষ্ট হয়ে যাবে, আগে এই খালের পানি আমরা কৃষি জমিতে সেচের জন্য ব্যবহার করতাম, এখন সেচের জন্য এই পানি ব্যাবহার তো করাই যায় না, এমনকি কিছু পানি জমিতে ঢুকলে সেই জমিতে আর নামা যায় না। তিনি আরো বলেন শুধু পানির সমস্যা নয় মিলের ধোঁয়া ও দুর্গন্ধে আমাদের বাচ্চাদের শ্বাসকষ্ট সহ ত্বকের চুলকানি ও এলার্জির সমস্যা বাড়ছে।

মিলটি দীর্ঘদিন ধরে পরিবেশ অধিদপ্তরের নিয়ম লঙ্ঘন করে বর্জ্য ফেলে আসছে, ভুক্তভোগী স্থানীয় জনসাধারণের এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতে, পরিবেশ অধিদপ্তর রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয়ের উপ-পরিচালক সাইফুল ইসলাম ও পরিবেশ অধিদপ্তর বগুড়া জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মাহাথির মোহাম্মদ এর নেতৃত্বে উক্ত কাগজ মিল পরিদর্শন করেন পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। এসময় তারা বর্জ্য মিশ্রিত খালের পানি পরিদর্শন করেন ও ভুক্তভোগী স্থানীয় জনগণের সাথে কথা বলেন। এসময় পরিবেশ অধিদপ্তর মিল কর্তৃপক্ষকে দূষিত পানি খোলা জায়গায় ও খালে ফেলতে কঠোরভাবে নিষেধ করেন, এবং তাদেরকে শিল্প কারখানার বর্জ্য জল শোধনাগার (ETP) সংস্কার করে তিনদিনের মধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তর বগুড়া জেলা কার্যালয়ে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলেন, অন্যথায় কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা সহ মিল বন্ধ করে দেয়া হবে বলে হুঁশিয়ার করেন।

এই প্রতিবেদক মিলের ব্যাবস্থাপক মোস্তাক আহমেদ এর কাছে দূষণ ছড়ানোর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি দুষন ছড়ানোর দ্বায় স্বীকার করে বলেন সিফ্ট পরিবর্তনের কারণে অল্প কিছু পানি ছাড়া হয়েছে, তবে আগামীতে আর এমনটি হবেনা।

স্থানীয় পরিবেশ ও জনজীবনের জন্য আজাদ পাল্প অ্যান্ড পেপার মিলে গড়ে তোলা রাসায়নিক দূষণ এখন এক নীরব বিপর্যয় ডেকে আনছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এই দূষণ রোধে কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে এই অঞ্চলটি অচিরেই কৃষি ও স্বাস্থ্য উভয় দিক থেকেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন পরিবেশ বাদিরা।

পরিবেশ দূষণ ছড়ানোর বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) বগুড়া, জেলা শাখার সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, সৈয়দ ফজলে রাব্বী ডলার এই প্রতিবেদককে বলেন “আগামী প্রজন্মের বাসযোগ্য নগরী বিনির্মাণে বাপা বগুড়া শাখা অঙ্গীকার বদ্ধ, আর সে কারণেই আমরা বরাবর জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরকে বলেছি, বগুড়া শহরতলী সহ জেলার বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা শিল্প কারখানা বর্জ্য পরিশোধনের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান সমূহ ইটিপি স্থাপন করলেও বিপুল পরিমাণ অর্থ সাশ্রয়ের জন্য তারা ইটিপি‌ ঠিকমতো পরিচালনা করে না। ফলস্রুতিতে যেই উদ্দেশ্যে ইটিপি স্থাপন তা ব্যাহত হচ্ছে এবং ব্যাপক মাত্রায় পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। আজাদ পেপার মিল তার ব্যতিক্রম নয়, আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছি, পরিবেশ দূষণ হয় এমন কোন কর্মকান্ড বগুড়ায় চলতে দেওয়া হবে না, সংশ্লিষ্টরা এ বিষয়ে ব্যবস্থা না নিলে, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাঁপা) বগুড়া জেলা শাখা বৃহত্তর সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলবে।”

কাগজ কারখানার রাসায়নিক মিশ্রিত পানি শোধন প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে কৃষি জমিতে পড়লে মাটির গুনগত মান ও কৃষি উৎপাদন হ্রাস বিষয়ে, মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, আঞ্চলিক কার্যালয়, বগুড়া, এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, কৃষিবিদ সৈয়দ আহসান রেজা চৌধুরী বলেন “পেপার মিলে ব্যবহৃত রাসায়নিক পদার্থগুলো যদি, ওটিপি প্লান্টে পরিশোধন না করে, নদী বা খালে ফেলা হয় তাহলে তা পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে, এতে থাকা বিষাক্ত রাসায়নিক এর কারণে যেমন জলজ প্রাণী মাছ ব্যাঙ পোকামাকড়ের ক্ষতি হবে, ঠিক তেমনি জনস্বাস্থ্য ও গবাদি পশুর স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি স্বরূপ হয়ে দেখা দিবে। কাগজ শিল্পের বর্জ্যে থাকা ক্লোরিন যৌগ ও সোডিয়াম-ভিত্তিক রাসায়নিক পদার্থ মাটির জৈব উপাদান ধ্বংস করে দেয়, তাই কৃষিজমির উর্বরতা দ্রুত কমে যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন এই বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা।”

দূষণ ছড়ানোর দায়ে আজাদ পেপার মিলের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে পরিবেশ অধিদপ্তর, রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক (উপসচিব), নিলুফা ইয়াছমিন, এই প্রতিবেদককে বলেন, “স্থানীয় জনগণের অভিযোগের ভিত্তিতে আমাদের অফিসের কর্মকর্তাগণ আজাদ পাল্প এন্ড পেপার মিল পরিদর্শন করেছেন, এবং প্রাথমিক তদন্তে দূষণ ছড়ানোর বিষয়ে প্রমাণ পাওয়া গেছে, সেই প্রমাণের ভিত্তিতে উক্ত প্রতিষ্ঠানকে কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রদান করে তিন কার্যদিবসের মধ্যে জবাব দিতে বলা হয়েছে।

আজাদ পেপার মিলের নোটিশের জবাব, এবং পরবর্তীতে পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক গৃহীত ব্যাবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে থাকছে দ্বিতীয় পর্বে।

শেয়ার করুনঃ