ভর্তুকির সারে সিন্ডিকেট টিএসপি বস্তা প্রতি ৪০০ থেকে ৮০০ টাকা বেশি মূল্যে বিক্রি, জরিমানা সত্ত্বেও কৃষকের ভোগান্তি

 

আজাদুর রহমান, বগুড়া:

বগুড়ার মাঠে আমন মৌসুমের মধ্যবর্তী দিনগুলোয় ফসলের ক্ষেতের পরিচর্যা ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষকরা। কিছুদিনের মধ্যেই ধানের গাছ থেকে শীষ বের হবে, আর তাই পরিচর্যার এই ব্যস্ততা। এরই মাঝেই ধানের গাছগুলোকে হৃষ্টপুষ্ট করতে জমিতে সার ও কীটনাশক প্রয়োগ করছেন আজন্ম পরিশ্রমী এই মানুষগুলো, এই সার কিনতে গিয়েই কৃষকের মাথায় পড়েছে চিন্তার ভাঁজ, চলছে আমন মৌসুমের মধ্যবর্তী সময় এবং সামনে আসছে আলু চাষের মৌসুম, সেই সাথে রবি শস্যের বীজ তলা প্রস্তুত করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন তারা। দিন-রাত চিন্তা একটাই কীভাবে পাবেন ন্যায্যমূল্যে সার। সরকার ভর্তুকি দিয়ে টিএসপি সারের দাম নির্ধারণ করেছে প্রতি বস্তা ১৩৫০ টাকা। কিন্তু বাস্তবে কৃষকদের কিনতে হচ্ছে ১৭৫০ টাকা থেকে ২০৫০ টাকা। অর্থাৎ বস্তাপ্রতি ৪০০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত খরচ গুনতে হচ্ছে, যা এক মৌসুমে একজন কৃষকের জন্য হাজার হাজার টাকার বাড়তি বোঝা তৈরি করছে।

কৃষকের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে সার সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম, শাজাহানপুর উপজেলার কৃষক কামাল প্রামাণিক বলেন, “আমার চার বিঘা জমির জন্য ১০ বস্তা টিএসপি লাগে। সরকারি দরে কিনলে খরচ হতো ১৩ হাজার ৫০০ টাকা। এখন দিতে হচ্ছে ১৭ হাজার ৫০০ থেকে ২০ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত। শুধু টিএসপি সারে-ই হাজার হাজার টাকা বেশি খরচ যাচ্ছে। ফসলের দাম তো সে হারে বাড়ে না, তাহলে আমরা বাঁচবো কীভাবে?”

সরকার নির্ধারিত মূল্য ১৩৫০ টাকা থাকার পরেও আপনারা অধিক মূল্য দিয়ে সার কেন কিনছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে গাবতলীর কৃষক রফিকুল ইসলাম ক্ষোভের সঙ্গে জানান, “ডিলারেরা বলে-গুদামে সরবরাহ কম। অথচ রাতে ট্রাকে করে অন্যত্র বাজারে সার পাঠিয়ে দেয়। এবং স্থানীয় ভাবে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়িয়ে দেয়। আমাদের হাতে বিকল্প নেই, বাধ্য হয়ে কিনতে হয়।”

এ বিষয়ে শাহ নগর সবজি নার্সারী মালিক সমিতির সভাপতি আমজাদ হোসেন বলেন, বিগত বছর গুলোর তুলনায় এবার সার নিয়ে যেই‌ কান্ড চলছে তাতে আমরা আতংকিত, আমি নিজেই প্রতি বস্তা টিএসপি সার কিনেছি ২০০০ টাকা থেকে ২২৫০ টাকায়, সরকার যেখানে প্রতি বস্তা সার ১৩৫০ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে সেখানে এমন অবিশ্বাস্য মূল্য অনাকাঙ্ক্ষিত, সার ডিলার পর্যায়ে ব্যাপকভাবে সিন্ডিকেট না হলে এই পরিস্থিতি কোন ভাবেই হতো না, তিনি আরো বলেন কৃষি ও কৃষক বাঁচাতে সার সিন্ডিকেট ভেঙে ফেলার বিকল্প নেই, তিনি কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এই সিন্ডিকেট ভেঙ্গে দেওয়ার আহবান জানান। সামনে রবি শস্যের মৌসুম আসছে তখন সারের চাহিদা আরো বৃদ্ধি পাবে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এখনি যদি এই সংকট উত্তরণের ব্যাবস্থা না করে তাহলে আগামীতে সার সংকট আরো তীব্র আকার ধারণ করবে বলে আশংকা প্রকাশ করেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে সার ডিলার ও কিছু খুচরা বিক্রেতা মিলে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। তারা ইচ্ছে করেই গুদামে সার আটকে রাখছে। এতেকরে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে তারপর বেশি দামে বিক্রি করছে। এতে সার পাওয়া যায় ঠিকই, কিন্তু সরকারি নির্ধারিত দামে নয়।

কৃষকের অভিযোগের প্রেক্ষিতে সম্প্রতি প্রশাসন মাঠে নামে। গত ১৭ আগস্ট জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এক ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন। এ সময় শাজাহানপুর উপজেলার আড়িয়া ইউনিয়নে মেসার্স নুর কৃষি ভান্ডার নামক একটি খুচরা সার বিক্রেতাকে সরকারি দামের (১৩৫০ টাকা) পরিবর্তে ১৭৫০ টাকায় সার বিক্রির অপরাধে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। একই সঙ্গে ১২ বস্তা সার জব্দ করা হয়। একইভাবে জেলার গাবতলী উপজেলায় ও শিবগঞ্জ উপজেলায় অভিযান পরিচালনা করে অধিক মূল্যে সার বিক্রি করায় জরিমানা আরোপ ও আদায় করা হয়।

তবে কৃষকদের অভিযোগ, এ ধরনের অভিযান একদিনের জন্য পরিস্থিতি সামলালেও স্থায়ী সমাধান আনে না। কারণ সিন্ডিকেট আবারও সক্রিয় হয়ে যায়।

কৃষি অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ভর্তুকি দিয়ে সরকার কৃষকের খরচ কমাতে চাইলেও সিন্ডিকেট সেই সুবিধা হাতিয়ে নিচ্ছে। এর ফলে কৃষকের উৎপাদন খরচ বাড়ছে, জমিতে ফসল চাষে নিরুৎসাহ তৈরি হচ্ছে, এতে করে দীর্ঘমেয়াদে খাদ্য উৎপাদন হ্রাস পেতে পারে, এমনকি বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ার ঝুঁকি ও তৈরি হচ্ছে।

সার সিন্ডিকেটের বিষয়ে জানতে বগুড়া ফার্টিলাইজার এসোসিয়েশন (বিএফএ) এর সভাপতি মোরশেদ মিল্টনের মন্তব্য জানাতে চাইলে তিনি এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদকের সাথে কথা বলতে বলেন, বিএফএ এর সাধারণ সম্পাদক এনামুল হক এনাম এর সাথে যোগাযোগ করলে তিনি প্রথমে কিছুটা সময় চেয়ে বলেন আমি একটু ব্যস্ত আছি আপনার সাথে একঘন্টা পরে কথা বলছি, একঘন্টা পরে তার সাথে একাধিক বার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তিনি আর ফোন রিসিভ করেননি।

এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামার বাড়ি, বগুড়া উপ-পরিচালক সোহেল মোঃ শামসুদ্দীন ফিরোজ বলেন “জেলায় কোনো সার সংকট নাই, এমনকি সিন্ডিকেট নিয়ে যেই কথা বলা হচ্ছে এটাও ভিত্তিহীন। তবে ভর্তুকির সার নিয়ে কোনো অনিয়ম প্রমাণিত হলে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে”।

সার সংকট এবং সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম রোধে জেলা প্রশাসকের ভূমিকা সম্বন্ধে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক ও বিজ্ঞ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হোসনা আফরোজা বলেন, “এখন বাজারে সারের যে সংকট দেখা যাচ্ছে তা পূর্ববর্তী কিছু ডিলার পরিকল্পিতভাবে একটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এই সংকট তৈরি করছে। আমরা মাঠে কাজ করছি সিন্ডিকেট চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

কৃষক ও সচেতন মহলের দাবি, “নিয়মিত বাজার মনিটরিং টিম গঠন করতে হবে, সিন্ডিকেটে জড়িত ডিলারদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে, প্রয়োজনে কৃষক পর্যায়ে সরাসরি সার বিতরণের ব্যবস্থা চালু করতে হবে। সে-ই সাথে তাদের একটাই কথা “আমরা ন্যায্যমূল্যে সার চাই। কৃষক বাঁচলে কৃষি বাঁচবে, কৃষি বাঁচলে দেশ বাঁচবে।”

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে বগুড়ায় বিসিআইসি ও বিএডিসির সার ডিলারের সংখ্যা মোট ৪০৩ জন কিন্তু সরেজমিনে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গিয়েছে এই বিপুলসংখ্যক সার ডিলারকে নিয়ন্ত্রণ করেন বগুড়ার মাত্র হাতে গোনা চারজন থেকে পাঁচজন ব্যক্তি।

সার সিন্ডিকেটের মূল হোতা এবং কারা কারা এই কারসাজিতে জড়িত এ নিয়ে বিস্তারিত ২য় পর্ব দেখতে চোখ রাখুন।

শেয়ার করুনঃ